শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী সন্তদাস কাঠিয়া বাবাজী মহারাজ

শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী সন্তদাস কাঠিয়া বাবাজী মহারাজ

ইনি আমার পরমপূজ্য পরদাদাগুরুজী মহারাজ এবং শ্রীশ্রী হংস ভগবান থেকে ৫৫তম অধস্তন আচার্য ছিলেন। ১৮৫৯ খৃষ্টাব্দে গঙ্গা দশহরার পবিত্র দিনে শ্রীহট্ট জেলার বামৈ গ্রামের একটি জমিদার বাড়ীতে তাঁর জন্ম হয়। পূর্বাশ্রমে তাঁর নাম ছিল শ্রীতারাকিশোর শর্মা চৌধুরী। ব্রাহ্মণ পরিবারে এই মহাপুরুষ বাল্যকালে থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন ছিলেন। শ্রীহট্ট শহরের উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রেন্স পাশ করে কলকাতায় কলেজে ভর্তি হলেন। বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে এফ.এ, প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বি.এ. এবং কলকাতা কলেজ থেকে দর্শন শাস্ত্রে (ফিলোসাফী) এম.এ. পাশ করলেন। সেই বছর তিনি ছাড়া অন্য কোনও ছাত্র দর্শনশাস্ত্রের পরীক্ষায় পাশ করতে পারে নি। এন্ট্রেন্স ও এফ.এ. পরীক্ষার পর তিনি ছাত্রবৃত্তি পেলেন। বি.এ. পাশ করার পর তিনি চাকরী করতে লাগলেন। এম.এ. পাশ করার পর তিনি বি.এল. পাশ করলেন এবং ওকালতী করতে লাগলেন। প্রথমে শ্রীহট্টে এবং পরে কলকাতা হাই কোর্টে তিনি ওকালতি করতেন। নিজের পেশায় তিনি বিপুল যশ এবং অর্থ প্রাপ্ত হয়েছিলেন।

যখন তাঁর বয়স মাত্র ১৫, তখন ১০ বছরের বালিকা শ্রীমতী অন্নদা দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। কলেজে পড়াকালে তিনি প্রথমে ব্রাহ্ম সমাজে যোগদান দিলেন। বহু বছর ব্রাহ্ম সমাজে থাকার পর তিনি তাকে ত্যাগ করে পুনরায় হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করলেন। তারপর তিনি একটি যোগী সম্প্রদায়ে প্রবেশ করে প্রাণায়ামাদি করতে লাগলেন। তিনি যখন যে কাজটি করতেন পূর্ণ মনোযোগ সহ করতেন সেই জন্য এই সম্প্রদায়ের প্রক্রিয়া দ্বারা তিনি প্রচুর আনন্দ ও শক্তি লাভ করেছিলেন কিন্তু তাতে তাঁর মন তৃপ্ত হতে পারে নি।সেই জন্য তিনি সদ্গুরু অন্বেষণ করতে লাগলেন।

শ্রী তারাকিশের চৌধুরীর অভ্যাস ছিল যে তিনি প্রত্যেক দিন গঙ্গা স্নান করতেন। হাওড়া ব্রীজের নিকট গঙ্গা তীরে জগন্নাথ ঘাটে এক দিন তিনি স্নান করতে গিয়েছিলেন। মন তখন তীব্র ভাবে সদ্গুরুর আশ্রয় পাবার জন্য লালায়িত ছিল। হঠাৎই তাঁর মনে এক তীব্র গ্লানি ও ক্ষোভের ভাব উদয় হল আর তিনি পতিতপাবনী গঙ্গাকে সকাতর ভাবে সম্বোধন করে মনে মনে বললেন, “হে পতিত পাবনী গঙ্গে ! জীবগণের অশেষ পাপ ধৌত করার জন্য মর্ত্য লোকে এসেছ। তুমি সমস্ত পাপ প্রণাশিনী বলে সমস্ত শাস্ত্রে বিখ্যাত। মা ! আমি কি এতই পাপী যে তুমি সর্ব পাপ বিনাশিনী হয়েও আমার পাপ সকল দুর করতে পার না ?” মুহুর্তের মধ্যে তাঁর সম্মুখের দৃশ্যটি আমূল পালটে গেল। জগন্নাথ ঘাটের স্থানে তিনি গঙ্গার উদ্গম স্থান গঙ্গোত্রী তাঁর সামনে ভেসে উঠল ও তাতে বিরাজমান হর-পার্বতী তাঁকে দর্শন দিলেন।শঙ্কর ভগবান তখন তাঁকে একটি একাক্ষরী বীজ মন্ত্র প্রদান করলেন এবং সেই মন্ত্র জপের প্রভাবে তাঁর সদ্গুরু লাভ হবে – এই রকম আশ্বাসন দিয়ে তাঁরা অন্তর্হিত হলেন। তখন হিমালয়ে সেই গোমুখ গঙ্গোত্রীর দৃশ্যও অন্তর্ধান হল। তিনি সেই বীজ মন্ত্র খুব নিষ্ঠার সাথে জপ করতে লাগলেন। সদ্গুরুর অন্বেষণে তিনি বিভিন্ন তীর্থ ঘুরতে লাগলেন এবং ক্রমেই তিনি তাঁর একটি বন্ধুর সহিত প্রয়াগ কুম্ভ মেলায় এসে পৌঁছালেন। এখানে তাঁর সাক্ষাৎকার তাঁর ভাবী গুরুদেব শ্রীশ্রী কাঠিয়া বাবাজী মহারাজের সাথে হলেও তিনি তাঁকে গুরুত্বে বরণ করবেন কি না সেই বিষয়ে সন্দিগ্ধ ছিলেন। তিনি শ্রীশ্রী কাঠিয়া বাবাজী মহারাজের কিছু কিছু অলৌকিক ব্যাপার দর্শন করলেন কিন্তু সম্পূর্ণরূপে সংশয়হীন হতে পারেন নি। তারপরে তিনি চৈত্র মাসে বৃন্দাবন গেলেন আর এবার তিনি কাঠিয়া বাবাজী মহারাজের অতি নিকট থেকে তাঁর কার্য্য কলাপ দর্শন করে প্রায় হতাশ হয়ে গেলেন। শ্রীশ্রী কাঠিয়া বাবাজী মহারাজকে ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ মনে করা ত দুরের কথা, তাঁকে শ্রী তারাকিশোর বাবু একটি সাধারণ বৃদ্ধ গ্রাম্য সাধু বলে মনে করলেন। কিন্তু যখন তাঁর অলৌকিক ক্রিয়া কলাপ মনে আসত তখন তিনি নিজের সিদ্ধান্ত ভূল কি ঠিক কিছুই বুঝতে পারতেন না। এই সংশয়গ্রস্ত মন নিয়ে তিনি কলকাতা প্রত্যাবর্তন করলেন।

কলকাতায় এক রাত্রিতে যখন তিনি বাড়ীর ছাদে শয়ন করছিলেন, তখন হঠাৎই নিদ্রাভঙ্গ হলে তিনি উঠে বসলেন। তিনি দেখলেন যে শ্রীশ্রীরামদাস কাঠিয়া বাবাজী মহারাজ আকাশ মার্গে আসছেন এবং ক্ষণকালের মধ্যেই তিনি সেই ছাদে তাঁর নিকট অবতীর্ণ হলেন। তার পর কাঠিয়া বাবাজী মহারাজ তাঁর কর্ণে একটি মন্ত্রোপদেশ প্রদান করে পুনরায় আকাশ মার্গে প্রস্থান করলেন।  শ্রী তারা কিশোর শর্মা চৌধুরীর মনে শ্রীশ্রী কাঠিয়া বাবাজী মহারাজের সম্বন্ধে অন্য কোনও সন্দেহ থাকল না। তাঁর সমস্ত দ্বিধা সেইক্ষণেই দূর হয়ে গেল এবং অভিলাষিত সদ্গুরুর আশ্রয় লাভ করেছেন বলে তিনি নিজেকে কৃতার্থ মনে করলেন। এইভাবে অলৌকিক ভাবে দীক্ষা পাবার পরেও তিনি বৃন্দাবনে ১৮৯৪ সালে জন্মাষ্টমীর দিনে লৌকিক ভাবে সস্ত্রীক দীক্ষা গ্রহণ করলেন।

এখানে তাঁর সংসারাশ্রমে থাকার প্রণালীর কিছু উল্লেখ করা অত্যাবশ্যক। শ্রী তারা কিশোর শর্মা চৌধুরী খুব সৎ জীবন যাপন করতেন। পেশায় তিনি উকিল ছিলেন কিন্তু কখনই  কোন মিথ্যা কেস নিতেন না। যেখানে মোক্কেলের কেসে কোনও রকম ভেজাল থাকত সেই মোক্কেলকে তিনি ফিরিয়ে দিতেন। গরীব লোকের কেস নিলে তিনি অনেক সময় বিনা ফিস নিয়ে তার কেস লড়তেন। কলকাতায় থাকাকালীন তাঁর বাড়ীতে প্রচুর লোক থাকত, অনেক ছাত্ররা সেখানে থেকে পড়াশোনা করত। বাড়িতে কে কখন এসে থাকতে আরম্ভ করবে সেই বিষয়ে কোনও বাধা বা নিষেধ ছিল না। থাকার জন্য আবার তাঁর অনুমতি নেওয়ারও কেউ প্রয়োজন মনে করত না। অনেক সময় মোক্কিলরাও কেস চলাকালীন বাড়ীতে থাকত, কিন্তু কেউ জিজ্ঞেস করত না যে কেন তারা উকিলের বাড়িতে থাকছে। যারা থাকত তাদের আবার অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থাও তাঁর টাকায় হত। এত সব হওয়ার পরেও কারুর মনেই আসত না যে এই সবের জন্য তাঁর অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বা তাঁকে জানানোর প্রয়োজন আছে। এই সব দেখে তাঁর একজন পরিচিত অভিযোগ করে তাঁর নিকট এই সব বিশৃঙ্খলার বিষয়ে নালিশ করলেন। উত্তরে শ্রী তারাকিশোর বললেন, “আপনি যেগুলো কথা বললেন সবই ঠিক। কিন্তু, আমি বুঝতে পারছি না যে এতে দোষ কার, আমার না তাদের ? আমি কখনই মনে করি নি যে এই বাড়ি বা সংসারটা আমার। আমি মনে করি এই সংসারটা ঠাকুরজীর। এখানে যেমন আমি থাকছি অন্যরাও থাকে, আমার খাবার দাবারের যে রকম ব্যবস্থা তাদের জন্যও ঠাকুরজী সেই ব্যবস্থা করছেন। তাঁর সংসার, তিনি যেমন ভাবে আমার জন্য সব জোগাড় করে দিচ্ছেন অন্যদের জন্যও তাই করছেন। কাজেই তারা আমার অনুমতির জন্য অপেক্ষা করবে কেন ?” সংসার ধর্ম পালন করেও কি করে অনাসক্ত ভাবে, ভগবৎবুদ্ধি সম্পন্ন হয়ে সংসারে থাকা যায় ও সংসারে থেকে কি ভাবে নিষ্কাম সেবা করা যায় তার আদর্শ তিনিই আমাদের সামনে রেখে গেছেন।

এত সব করার পরে তিনি নিজের সাধন ভজনের প্রতি খুব সজাগ থাকতেন এবং গুরুদেবের আদেশানুসার নিজের জপ-ধ্যান ইত্যাদি অবশ্যই করতেন। তাঁর নিয়ম ছিল কাছারী থেকে ফিরে আসার পর তিনি কেস-মামলা ইত্যাদির বিষয়ে কোনও রকম কাজ করতেন না, সেই সময় তিনি নিজের জপ-ধ্যান, শাস্ত্র পাঠ ইত্যাদি আধ্যাত্মিক কাজে ব্যাপিত থাকতেন। গৃহস্থাশ্রমে বাসকালে তিনি খুব ভক্তিসহ গুরুসেবা করতেন ও গুরুদেবের আদেশ করার জন্য সদা তৎপর থাকতেন। তাঁকে পরীক্ষা করার জন্য গুরুদেব তাঁকে আশ্রমের জন্য কোনও কিছু আনতে বললে তিনি নির্বিচারে সেই সব নিয়ে আসতেন। এমন কি তিনি আশ্রমের গরুর জন্য ভুসী নিজের মাথায় বহন করেও এনেছিলেন। এতে তাঁর কোনও রকম সংকোচ বা লজ্জা বোধ আসত না। গুরুদেবের সঙ্গে তিনি অনেক বার ব্রজ পরিক্রমায় গেছলেন এবং সব সময় তিনি গুরুদেবের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। ছিন্নু সিং যে জমিটি শ্রীশ্রী কাঠিয়া বাবাজী মহারাজকে দান করেছিলেন সেখানে গুরুদেবের জন্য একটি আশ্রম তৈরী করার পরিকল্পনা শ্রী তারা কিশোর চৌধুরী করলেন। গুরুদেবের অনুমতি নিয়ে তিনি একটি বৃহৎ আশ্রমের নির্মাণ করতে লাগলেন। তিনি কলকাতা থেকে অর্থ পাঠাতেন এবং শ্রীশ্রী কাঠিয়া বাবাজী মহারাজের তত্ত্বাবাধানে বৃন্দাবনে “নিম্বার্ক আশ্রম” তৈরী হতে লাগল। কিন্তু আশ্রম সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই শ্রীশ্রী কাঠিয়া বাবাজী মহারাজ মর্ত্য দেহ লীলা সম্বরণ করে ব্রহ্মলীন হয়ে গেলেন। তাঁর গুরুদেবের দেহাবসানের পরও শ্রী তারাকিশোর আশ্রম তৈরী করার কাজটি অব্যাহত রাখলেন। বরং তাঁকে এই কাজটি সম্পূর্ণ করার জন্য প্রায় বত্রিশ হাজার টাকা ঋণ করতে হয়েছিল। কিন্তু শ্রীশ্রী গুরুদেবের কৃপায় সেই ঋণ তিনি অল্প সময়ের মধ্যে শোধ করে দিলেন।

শ্রীশ্রী কাঠিয়া বাবাজী মহারাজ তাঁর গুরুভক্তি ও গুরুসেবায় অতি প্রসন্ন হয়ে তাঁকে একদা বললেন, “বাবু, এই ঠাকুরজী খুব জাগ্রত ও সামর্থী। তুমি এখন এই ঠাকুরজীর কাছে গিয়ে যা খুশী বর প্রার্থনা কর, তিনি তোমাকে বর দান করবেন।” তিনি বললেন, “বাবা, আপনার প্রসন্নতাই আমার কাম্য। আপনি আমার প্রতি প্রসন্ন হলেই আমার সর্বাভীষ্ট সিদ্ধ হবে।” গুরুদেব বললেন, “তুমি যা বলছ সম্পূর্ণরূপে সত্য, তবে একট আধটু পরীক্ষাও ত করা চাই, না হলে চলবে কেন ? ইনি অতি কেরামতী ঠাকুর, আমি বলছি, তুমি এনার কাছে ইচ্ছা মত বর চেয়ে নাও।” তখন শ্রী তারা কিশোর গুরুদেবের আদেশ পালনার্থ শ্রীঠাকুরজীর নিকট গিয়ে মনে মনে প্রার্থনা করলেন যে, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় সাধকের যেসকল উচ্চাবস্থা বর্ণিত আছে তন্মধ্যে মনুষ্য শরীর নিয়ে যতদূর উচ্চাবস্থায় গমন করা সম্ভব, তিনি সাধনায় যেন ততদূর যেতে সক্ষম হন। তাঁর বর প্রার্থনা সমাপ্ত হলে তিনি নিজ স্থানে প্রত্যাবর্তন করলেন। তখন শ্রীশ্রীকাঠিয়া বাবাজী মহারাজ তাঁর নিকটে গিয়ে সেই সমস্ত বরগুলির পুনরাবৃত্তি করে বললেন যে, “তোমার এই সমস্ত লাভ হবে, তোমার সর্বাভীষ্ট সিদ্ধ হবে, তোমার ঋদ্ধি-সিদ্ধি সর্বদা অটুট থাকবে, তুমি মহন্তাই পাবে। তোমার ভগবৎ সাক্ষাৎকার হবে, এই সব যদি সত্য না হয় তাহলে আমি যথার্থ সাধু নই।” শ্রী তারাকিশোর এই রকম সামর্থী ব্রহ্মজ্ঞ গুরুকে পেয়ে নিজেকে কৃতার্থ মনে করলেন।

নিম্বার্ক আশ্রম সম্পূর্ণরূপে তৈরী হওয়ার পূর্বেই শ্রীশ্রী কাঠিয়া বাবাজী মহারাজের দেহাবসান হল। গুরুদেবের দেহ লীলা সম্বরণের পর প্রায় পাঁচ বছর শ্রী তারাকিশোর সংসার ধর্ম পালন করেছিলেন। এর মধ্যেই তিনি গুরুদেবের ইচ্ছানুসারে অনেক দর্শনশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তার মধ্যে রয়েছে – ১) ব্রহ্মবাদীঋষি ও ব্রহ্মবিদ্যা, ২) দার্শনিক ব্রহ্মবিদ্যা (ক) প্রথম খন্ড – এই খন্ডে রয়েছে, বৈশেষিক দর্শন, ন্যায় দর্শন, পূর্বমীমাংসা দর্শন, সাংখ্য প্রবচন সূত্র, তত্ত্ব সমাস এবং সাংখ্যকারিকা। (খ) দ্বিতীয় খন্ড – পাতাঞ্জল দর্শন। (গ) তৃতীয় খন্ড হচ্ছে – বেদান্ত দর্শন বা ব্রহ্মসূত্র বা উত্তর মীমাংসা। এই সমস্ত গ্রন্থ প্রথম বার ১৯১১ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল এবং এখনো পর্যন্ত প্রয়োজনানুসারে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। গৃহস্থাশ্রম থাকাকালীনই তিনি তাঁর গুরুদেব শ্রীশ্রী রামদাস কাঠিয়া বাবাজী মহারাজের জীবন চরিত রচনা করেন।

তাঁর গুরুদেবের মানবলীলা সম্বরণের কিছু বছর পর তিনি ভগবদ্দর্শনের জন্য বিশেষ ভাবে অধীর হয়ে গেলেন। যখন তিনি পেশায় শিখরে, এবার ব্রিটিশ আমলে তিনি জাজ হওয়ার নিযুক্তির মুখে, তখনই তিনি সেই সমস্ত ত্যাগ করে দিলেন। নিজের সমস্ত কিছু আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে তিনি কপর্দকশূন্য হয়ে ৫৬ বছর বয়সে সস্ত্রীক বৃন্দাবনে নিম্বার্ক আশ্রমে চলে গেলেন। বৃন্দাবনে বানপ্রস্থ আশ্রম গ্রহণ করে তিনি শ্রী ঠাকুরজীর সেবায় ও কঠোর তপশ্চরণে নিজেকে নিমজ্জিত করে দিলেন। শ্রীশ্রী কাঠিয়া বাবার বরানুযায়ী তিনি দু বছর কঠোর সাধনার পর ৫৮ বছর বয়সে সম্পূর্ণ সিদ্ধ মনোরথ হলেন। তারপরই তিনি দীক্ষা দান করতে আরম্ভ করেন। গুরুদেবের বরদান আরও প্রখর ভাবে ফলে উঠল যখন বৃন্দবনের বিশিষ্ট সাধু মন্ডল তাঁকে স্বতঃ প্রবৃত্ত হয়ে নিম্বার্ক আশ্রমের মহন্ত পদ ও ব্রজবিদেহী মহন্ত পদ প্রদান করল। তার পূর্বে তাঁর সন্ন্যাস পর্যন্ত হয়নি। সাধুরা তখন সেই সময়ই তাঁকে সম্মিলিত ভাবে সন্ন্যাস প্রদান করল। ব্রজের সাধু মন্ডলী তাঁকে সন্ন্যাস প্রদান করার হেতু তাঁর সন্ন্যাসাশ্রমের নামকরণ হল “সন্তদাস”। তার পরেই যে কুম্ভ মেলা অনুষ্ঠিত হয় তাতেই তাঁকে চতুঃসম্প্রদায়ের শ্রীমহন্ত পদেও অভিষিক্ত করা হল।

তাঁর সিদ্ধিলাভের পরেই তিনি দীক্ষা দান করতে আরম্ভ করেন। তাঁর সাধু শিষ্য ছিলেন ৪১ জন এবং দীক্ষিত শিষ্যের সংখ্যা ছিল ৩০৩৭। তা ছাড়া তিনি অসংখ্য মুমুক্ষুদের নাম মন্ত্র প্রদান করে কৃতার্থ করেছিলেন। সন্ন্যাসাশ্রমে থাকাকালীন তিনি ১) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ২) দ্বৈতাদ্বৈত সিদ্ধান্ত, ৩) গুরুশিষ্য সংবাদ  প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। বঙ্গদেশে তখন নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের কোনও আশ্রম ছিল না, শিবপুর হাওড়ায় তিনি নিম্বার্ক আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে সেই অভাব দুর করলেন। তার পর তিনি শ্রীহট্ট জেলায়ও একটি নিম্বার্ক আশ্রম প্রতিষ্ঠা করলেন। উড়িষ্যা রাজ্যের রাজধানী ভুবনেশ্বরেও তিনি আশ্রম প্রতিষ্ঠার জন্য কৃত সংকল্প হন, সেখানে জমি ক্রয় করা হল এবং তিনি আশ্রমের নক্সা পর্যন্ত তৈরী করেছিলেন, কিন্তু তাঁর জীবিত কালে সেটি সম্পূর্ণ হতে পার নি। তাঁর দেহাবসানের পর সেটা নির্মিত হয়।

অগণিত বদ্ধ জীবকে মুক্তি পথের পথিক করে, বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন রূপে তাঁদের মার্গদর্শন করে , এই ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ ১৯৩৫ খৃষ্টাব্দে মানবলীলা সম্বরণ করে গোলোকের জন্য মহাপ্রয়াণ করলেন।

শ্রীশ্রীসন্তদাসাষ্টকম
‘ব্ৰহ্মণে সন্তদাসায় বিশুদ্ধায় মহাত্মনে।
আচাৰ্য্যায় মুনীন্দ্রায় ব্রজবিদেহিনে নমঃ।।১।।
দ্বৈতাদ্বৈতপ্রবক্ত্রে চ শ্রীনিম্বার্কানুগামিনে।
পারঙ্গতায় শাস্ত্রাণাং বিদ্যানাং নিধয়ে নমঃ।।২।।
নমঃ প্রশান্তরূপায় ভক্তিমুক্তিপ্রদায়িনে।
কলৌ পূতাবতারায় পতিতোদ্ধারিণে নমঃ।।৩।।
নমস্তে নিৰ্ব্বিকারায় স্বরূপানন্দরূপিণে।
ব্রহ্মভূতস্বরূপায় সৰ্ব্বভূতাত্মনে নমঃ।।৪।।।
সৰ্ব্বপাপপ্রণাশায় যমপাশাপহারিণে।।
সৰ্ব্বভূতনিবাসায় স্বাত্মারামায় তে নমঃ।।৫।।
শ্রীরামদাসশিষ্যায় কৃষ্ণপদবিহারিণে। স্বানন্দপরিপূর্ণায় নমো বিজ্ঞানমূৰ্তয়ে।৬।।।
ক্রীড়া সংদৃশ্যতে যেন কৃষ্ণস্য পরমাত্মনঃ। বৃন্দাবননিবাসায় সন্তদাসায় তে নমঃ।।৭।।।
স্বস্থানে স্থাপিতা যেন সাধুসেবা কলৌ যুগে।
প্রণমামো বয়ং নিত্যং সন্তদাসং তমন্বহম্।।৮।
গুৰ্ব্বষ্টকমিদং স্তোত্রং ‘প্রেমদাসেন ভাষিতম্।।
শ্ৰদ্ধয়া প্রপঠন্ নিত্যং প্রয়াতি পরমাং গতিম্।।
তস্য কাপি ভয়ং নাস্তি তমঃ সূর্যোদয়ে যথা।
ত্রিসন্ধ্যং যঃ পঠেৎ স্তোত্রং স ভক্তিং লভতে পরাম্।।’
ইতি প্রেমদাসেন কৃতং সন্তদাসাষ্টকম্ সমাপ্তম্।

CONTINUE READING
Share this post
Come2theweb