প্রায় পাঁচ হাজার বছরেরও অধিক কালে পূর্বে, দ্বাপর যুগের শেষ কালে ও কলিযুগের প্রারম্ভে এই পৃথ্বী নাস্তিকতা, অধর্ম, ইত্যাদির দ্বারা পরিপূর্ণ হয়। শ্রীকৃষ্ণ তখন মনুষ্য দেহ ত্যাগ করে নিজের বৈকুন্ঠধামে ফিরে গেছেন। মর্ত্যলোকের জীবগণের দুর্দশা দেখে করুণাময় নারদ ভগবানের অনুরোধে ব্রহ্মা ও সমস্ত দেবতাগণ গোলোকে ভগবানের নিকট গেলেন ও পৃথ্বীবাসীদের প্রতি কৃপা বর্ষণ করার জন্য অনুরোধ করলেন। তখন ভগবান নিজ পার্ষদ ও অভিন্ন শক্তি সুদর্শন চক্রের অবতার গ্রহণের ব্যবস্থা করলেন।
সুদর্শনো দ্বাপরান্তে কৃষ্ণাজ্ঞাপ্তো জনিষ্যতি।
নিম্বাদিত্য ইতি খ্যাতো ধর্মগ্লানিং হরিষ্যতি।। (ভবিষ্য পুরাণ, প্রতিসর্গ পর্ব, ৪।৭।৬৭)
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদেশে দ্বাপর যুগের শেষে সুদর্শন চক্র জন্ম গ্রহণ করবেন। তিনি নিম্বাদিত্য নামে প্রসিদ্ধ হয়ে ধর্মগ্লানি হরণ করবেন।
ভগবান সুদর্শনকে অনেক আদেশ করে বললেন, “তুমি ধর্মস্থাপনরূপ জগৎকল্যাণ কার্য করবে এবং হংস বা সন্ সম্প্রদায়ের নামে যে এক প্রাচীন সম্প্রদায় আছে, সেটি তোমার নামে প্রসিদ্ধ হবে।”
ভগবানের বিধানানুসারে সুদর্শন তৈলঙ্গ দেশে বৈদুর্যপত্তন নামক গ্রামে এক ঋষি দম্পত্তির গৃহে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন সর্বশাস্ত্র বিশারদ ঋষি অরুণ ও মাতা ছিলেন জয়ন্তী। তাঁরা বহু কাল পুত্র লাভের জন্য শ্রী ভগবানের আরাধনা করেছিলেন। কোন সন্তান না হওয়াতে তাঁদের মনে পুত্র প্রাপ্তির জন্য বিশেষ ইচ্ছা ছিল। একদা যখন অরুণ ঋষি স্ত্রীসহ শ্বশুরালয়ে ছিলেন সেই সময়ে গভীর রাত্রে তাঁরা দেখলেন যে, একটি দিব্য জ্যোতি তাঁদের শয়নকক্ষে প্রকাশিত হল এবং জয়ন্তীর গর্ভে প্রবেশ করল। তারপর একটি দৈববাণী তাঁদেরকে সম্বোধন করে বললেন, “শ্রী ভগবানের পার্ষদ সুদর্শন চক্র তোমাদের পুত্ররূপে জন্ম গ্রহণ করবেন।” তখন ছিল শীতকালের মাঘ মাস। তাঁরা নিজের আশ্রমে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং নয় মাস গত হলে দশম মাসে জয়ন্তীদেবী একটি সুলক্ষণ পুত্র সন্তানকে প্রসব করলেন। ভবিষ্য পুরাণে তাঁর জন্ম সম্বন্ধে এই রকম উল্লেখ পাওয়া যায়, যথা –
কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষে পূর্ণিমা তিথিতে বৃষরাশিতে চন্দ্রে কৃত্তিকা নক্ষত্রে পাঁচটি গ্রহ উচ্চস্থ হলে পরম রমণীয় সূর্যাবসানকালে নিশা মুখে মেষ লগ্নে জয়রূপিণী জয়ন্তীর গর্ভে জগদীশ্বর জন্ম গ্রহণ করলেন। (ভ,পু, প্র,প, ৪।৭।৭৭-৭৯)
ঋষি দম্পত্তি পুত্রের নামকরণ করলেন – নিয়মানন্দ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদেশে নারদ ভগবান ঋষি দম্পত্তিকে তাঁদের সন্তানের জন্ম হওয়ার পূর্বে দর্শন দিয়ে বলেছিলেন যে, শ্রীভগবানের সুদর্শনই তাঁদের গৃহে পুত্ররূপে জন্ম গ্রহণ করবেন। সেই বালককে নারদ স্বয়ং লৌকিক ভাবে দীক্ষা প্রদান করবেন এটাও তিনি প্রকাশ করলেন। নিয়মানন্দের জন্মের কিছু কাল পরে, শিশুর উপনয়ন, চুড়াকরণ আদি সংস্কার সম্পন্ন হলে, ঋষি দম্পত্তি নারদ ভগবানের আদেশে তৈলঙ্গ দেশ ত্যাগ করে ব্রজধামে গমন করলেন। ব্রজধামে নিয়মানন্দের শাস্ত্রাধ্যয়ন আরম্ভ হয়। নিয়মানন্দ শ্রুতিধর ছিলেন, অর্থাৎ – তিনি একবার যেটা শ্রবণ করতেন সেটাই তিনি মুখস্থ ও কন্ঠস্থ করতে পারতেন। এই ভাবে গোবর্ধন গিরি পাদদেশে স্থিত নিম্বগ্রামে তাঁর শিক্ষা অতি দ্রুত গতিতে চলতে লাগল। নিম্বগ্রামে (অধুনাকালে নিমগাঁও) কিছু কাল থাকার পর একদা নারদ ভগবান ঋষি দম্পত্তির সম্মুখে অবতীর্ণ হলেন। অরুণ ও জয়ন্তী তাঁর যথাযোগ্য সেবা-পূজা- আতিথ্য করলেন। নারদ ভগবান বললেন যে তিনি নিয়মানন্দকে লৌকিক ভাবে দীক্ষা প্রদান করতে এসেছেন। সেই সময় নিয়মানন্দ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নারদ ভগবানের নিকট আবির্ভূত দেখলেন এবং তাঁকে দর্শন করে নিয়মানন্দ কিছু সময়ের জন্য বাহ্যজ্ঞান রহিত হয়ে গেলেন। যখন তাঁর বাহ্য জ্ঞান ফিরে এল তখন তিনি শ্রীভগবান ও নারদ মুনি উভয়কে প্রণাম করলেন। তখন নারদ ভগবানের সম্মুখেই বালক নিয়মানন্দকে কোলে স্থাপন করে দীক্ষা ও নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচর্য প্রদান করে সমস্ত ব্রহ্মবিদ্যা উপদেশ করলেন। সেই বিদ্যাকে ধারণ করার জন্য ও তার স্ফূরণের জন্য নিয়মানন্দকে কঠোর তপস্যার উপদেশ দিয়ে নারদ ভগবান অন্তর্হিত হলেন। গুরুর নিকট দীক্ষা প্রাপ্ত হয়ে এবার নিয়মানন্দ কঠোর তপশ্চরণ আরম্ভ করলেন। নিদ্রা-বিশ্রাম বিসর্জন দিয়ে, নিম্বফল ছাড়া অন্য প্রকারের আহার ত্যাগ করে তিনি দিবা নিশি তপস্যা করতে লাগলেন এবং শেষে সর্বসিদ্ধি লাভ করে আপ্তকাম ও আত্মারাম হয়ে গেলেন।
তারপরে নিয়মানন্দ জগৎ কল্যানের জন্য তীর্থাদি ভ্রমণ, ধর্ম প্রচার, শিষ্যকরণ ইত্যাদি করতে লাগলেন। তাঁর উজ্জ্বল কান্তি ও তপোদীপ্ত মুখশ্রী দর্শন করে অনেক জীব তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাঁর আশ্রয় গ্রহণ করলেন। কিন্তু একদল লোক তাঁর এই সকল বিভূতি ও প্রচার দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করতে লাগল। তিনি নিন্দা ও প্রশংসায় সমান থাকতেন কিন্তু কখনো কখনো লোক কল্যাণের জন্য নিজের বিভূতি প্রকাশও করতেন। তীর্থ ভ্রমণকালে একদা তিনি পদ্মনাভপুরীতে পৌঁছালেন। সেখানকার আদিবাসীরা তাঁর অনেক আদর-সৎকার করল ও অনেকেই তাঁর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করল। এই সব দেখে একদল লোক তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করতে লাগল। নিয়মানন্দ তখন শহর থেকে দূরে একটি তপোবনে নিজের আসন স্থাপন করলেন। একদিন সেই তপোবনে তিনি একটি যজ্ঞডুমুর গাছের নিচে একান্তে বসে গভীর আরাধনায় নিমগ্ন ছিলেন। একদিন কিছু দুষ্কৃতিকারী লোকেরা তাঁকে হত্যা করার জন্য সেখানে এলেন। নিয়মানন্দ তাঁদের প্রতি শুধুমাত্র দৃষ্টিপাত করেছিলেন। ঠিক সেই সময় গাছ থেকে একটি ডুমুর পতিত হয়ে তাঁর চরণ স্পর্শ করল। তাঁর চরণ স্পর্শ মাত্রে সেই ডুমুরফলটি দ্বিখন্ডিত হয়ে গেল ও তার মধ্যে দিয়ে একটি দিব্য পুরুষ আবির্ভূত হলেন। ডুমুরকে উদুম্বর বলা হয়, এবং উদুম্বর ফলের মধ্যে থেকে উৎপন্ন বলে সেই দিব্যকান্তু পুরুষের নাম হল “ঔদুম্বরাচার্য”। এই অলৌকিক ঘটনা দর্শন করেও তারা নিজের পাপাভিসন্ধি থেকে বিরত হল না। বরং ধ্যানমগ্ন নিয়মানন্দের চারি দিকে তারা কাঠ সাজিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে দিল। নিমেষের মধ্যে দাউ দাউ করে অগ্নি প্রজ্বলিত হয়ে উঠল এবং ধ্যানস্থ নিয়মানন্দকে সম্পূর্ণরূপে ঢেকে দিল। তাদের আশা সফল হয়েছে বলে দুষ্কৃতীরা আনন্দিত হল কিন্তু যখন অগ্নি নির্বাপিত হল তখন সেই ভস্মরাশির স্তূপ মধ্যে উজ্জ্বল কান্তি নিয়মানন্দকে জীবিত দর্শন করে তারা ভীত হয়ে পলায়ন করতে লাগল। এদিকে শ্রীভগবান দুষ্টদের দন্ড দেওয়ার জন্য ভয়াবহ নৃসিংহরূপ ধারণ করে সেইস্থানে আবির্ভূত হলেন এবং তাদের ভক্ষণ করতে উদ্যত হলেন। তখন তারা প্রাণের ভয়ে শ্রী নিম্বার্ক ভগবানের চরণে পতিত হয়ে ক্ষমা যাচনা করতে লাগল। শ্রীভগবান তখন তাঁর নৃসিংহ রূপ সংবরণ করে সেই স্থান থেকে অন্তর্হিত হলেন। শ্রী নিয়মানন্দ কি করে নিম্বার্ক বলে খ্যাতি লাভ করেছিলেন সেই ঘটনার উল্লেখ অত্যাবশ্যক।
নিয়মানন্দের অলৌকিক লীলা ও যোগবলের কথা তখন সর্বত্র প্রচারিত ও প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে। যোগবল ও নানা প্রকার বিভূতির প্রকাশ তাঁর বাল্যাবস্থা থেকেই দৃষ্টিগোচর হত। সেই যোগবলকে পরীক্ষা করার জন্য একদা এক দিবাভোজী (যিনি সূর্যাস্তের পর আহার করেন না) যতি নিম্বগ্রামে তাঁর আশ্রমে উপস্থিত হলেন। কোথাও কোথাও উল্লেখ পাওয়া যায় যে অতিথি এক ব্রাহ্মণ ছিলেন পরন্তু ভবিষ্য পুরাণে বলা আছে যে, তাঁর যোগবল দর্শন করার জন্য স্বয়ং পরমপিতা ব্রহ্মাই এসেছিলেন। যাই হোক্, সেই যতি দিবা থাকতে থাকতেই আগমন করেছিলেন। আচার্য তাঁর যোগবলে যতির জন্য অনেক প্রকারের সুস্বাদু আহার্য বস্তু সকল আনয়ন করলেন। যতি তখন নিজের নিত্য ক্রিয়ার জন্য প্রস্থান করলেন। এদিকে প্রায় সূর্যাস্ত হয়ে চলেছে কিন্তু যতি নিত্য ক্রিয়া থেকে নিবৃত্ত হয়ে ফেরেন নি দেখে আচার্য ভাবতে লাগলেন যে সূর্যাস্ত হলে ত যতি আহার গ্রহণ করবেন না এবং অভুক্ত থাকবেন। অতিথি যাতে নির্বিঘ্নে আহার করতে পারেন সেই জন্য আচার্য ভগবানের সুদর্শন চক্রকে আহ্বান করলেন ও আশ্রমে স্থিত একটি নিম্ব গাছের উপরে তাকে স্থির করে দিলেন। প্রভাযুক্ত সুদর্শন চক্রকে সূর্য মনে করে অতিথি মনে করলেন যে এখনো সূর্যাস্ত হয়নি এবং প্রসন্ন মনে তৃপ্তির সহিত ভোজন করলেন। অতিথির ভোজন সমাপ্ত হলে আচার্য সুদর্শন চক্রকে প্রত্যাহার করলেন। যতি তখন দেখলেন যে সূর্যাস্ত বহু পূর্বে হয়ে গেছে এবং রাত্রির এক চতুর্থাংশ শেষ হয়ে গেছে। আচার্যের যোগবল দর্শন করে যতি অতিশয় আনন্দিত হলেন এবং তাঁকে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করলেন। যেহেতু আচার্য নিম্ব বৃক্ষের উপরে সূর্যকে স্থাপিত করেছিলেন সেই জন্য তিনি পরবর্তী কালে “নিম্বার্ক” (নিম্ব-নিম, অর্ক-সূর্য) বা “নিম্বাদিত্য”(নিম্ব-নিম, আদিত্য-সূর্য) বলে খ্যাতি লাভ করেছিলেন।
ব্রজভূমিতে থাকাকালীন তাঁর তপোদীপ্ত মনোহারী উজ্জ্বল মূর্তি, তাঁর সর্বশাস্ত্রে পান্ডিত্ব, অলৌকিক যোগবল, আচার্য উচিত লীলার প্রকাশ চারি দিকে প্রসিদ্ধ হয়েছিল। সেই সময় এক দিগ্বিজয়ী পন্ডিত আচার্যের খ্যাতি শ্রবণ করে তাঁকে শাস্ত্রবিচারে পরাভূত করতে ব্রজভূমির সেই আশ্রমে আগমন করলেন। সেই পন্ডিতের নাম ছিল বিদ্যানিধি। সে আচার্যকে শাস্ত্রবিচারে আহ্বান করলে তিনি (আচার্য) বললেন, “তুমি প্রথমে আমার শিষ্য ঔদুম্বরাচার্যের সাথে বিচারে বস। যদি তুমি তাকে পরাজিত করতে পার তাহলে আমি তোমার সাথে শাস্ত্রার্থের বিচারে বসব।” ঔদুম্বরাচার্য অনায়াসেই বিদ্যানিধিকে শাস্ত্রার্থে পরাজিত করলেন। আচার্যের শিষ্যের শাস্ত্রজ্ঞান দেখে বিদ্যানিধি নিম্বার্কাচার্যের শরণাপন্ন হয়ে তাঁর নিকট দীক্ষা ও নৈষ্ঠিক সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন। তাঁর নতুন নাম হল – শ্রীনিবাসাচার্য।
এই সম্প্রদায় পূর্বে সনকাদির ঋষিদের সময় হংস সম্প্রদায় এবং নারদ ঋষির সময় সন্ সম্প্রদায়, উভয় নামেই প্রসিদ্ধ ছিল। শ্রীশ্রী হংস ভগবান থেকে প্রথমে প্রবর্তিত বলে “হংস সম্প্রদায়”, এবং সনকাদি ঋষি থেকে পরম্পরারূপে আগত বলে “সন্ সম্প্রদায়” নামে প্রসিদ্ধ ছিল। শ্রীনিম্বার্ক ভগবানের প্রতি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বর ছিল যে – আদি হংস বা সন্ সম্প্রদায় তাঁর নামে কলিকালে খ্যাতি লাভ করবে। সেই জন্য এই সম্প্রদায় এখন নিম্বার্ক সম্প্রদায় নামে খ্যাত হয়েছে।