যে সম্প্রদায়ের সাধন প্রণালী সম্বন্ধে বর্ণনা করা এই ওয়েব সাইটের উদ্দেশ্য তার সম্বন্ধে কিছু জ্ঞান হওয়া আবশ্যক। এই সম্প্রদায়ের নাম নিম্বার্ক সম্প্রদায়। বৈষ্ণব চারি সম্প্রদায়ের মধ্যে এটি এক অতি প্রাচীন ও বিখ্যাত সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ের আশ্রিত সাধকগণকে বৈষ্ণব বলা হয়। এই বৈষ্ণব শব্দের অর্থ কি ? বৈষ্ণব শব্দটি বিষ্ণু শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ হচ্ছে “বিষ্ণুরস্য দেবতা বৈষ্ণবঃ” অর্থাৎ, বিষ্ণু (অথবা তাঁর কোন অবতার যেমন, শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ) যাদের উপাস্য দেবতা তাদেরকে বৈষ্ণব বলা হয়।
বিষ্ণু শব্দটি সংস্কৃতে বিষ্ অথবা বিশ্ ধাতু থেকে উৎপন্ন হয়েছে। বিষ্ ধাতু ব্যপন অর্থক সেই জন্য বিষ্ ধাতু প্রয়োগ করলে বিষ্ণু শব্দের অর্থ হয় ব্যাপক। অর্থাৎ, যিনি এই সকল অনন্ত বিশ্বব্রহ্মান্ডে সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে আছেন তিনি বিষ্ণু। আবার বিশ্ ধাতু ব্যবহার করলে এটা প্রবেশ করা অর্থে ব্যহবার করা হয়। সেই জন্য এই অর্থ ব্যবহার করলে বিষ্ণু শব্দের অর্থ হয় – যিনি এই অনন্ত বিশ্বব্রহ্মান্ডে সর্বত্র প্রবিষ্ট হয়ে আছেন তিনি বিষ্ণু।
বস্তুতঃ যে কোনও ভাবেই বিচার করা যায় দুটোর অর্থ একই দাঁড়ায় আর সেটা হচ্ছে যে, যিনি সর্বব্যাপী ও সর্বাত্মারূপে সকলের অন্তরে প্রবিষ্ট হয়ে আছেন তিনিই বিষ্ণু। ভক্তগণ তাঁকে ভগবান বলে ডাকেন। ভগবান অর্থাৎ –
ঐশ্বর্যস্য সমগ্রস্য বীর্য্যস্য যশসঃ শ্রিয়ঃ।
জ্ঞান বৈরাগ্যয়োশ্চৈব ষণ্ণাং ভগ ইতীঙ্গনা।। (বিষ্ণুপুরাণ, ৬।৫।৭৪)
অর্থাৎ – সমস্ত ঐশ্বর্য্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান, ও বৈরাগ্য, এই ছয়টি ভগ শব্দ বাচ্য। যিনি পূর্ণরূপে এই ছয় গুণ বিশিষ্ট তিনিই ভগবান বলে কথিত হন।
১) ঐশ্বর্য্য – যিনি অতিশয় প্রভাবশালী বা যাঁর প্রভাব এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে সর্বাধিক।
২) বীর্য্য – যিনি অচিন্ত্য শক্তিশালী।
৩) যশ – সমস্ত সদ্গুণ যাঁর মধ্যে বিরাজমান বলে যিনি বিখ্যাত।
৪) শ্রী – যিনি সর্ববিধ সম্পতি সম্পন্ন বা যাঁর কোনও রকম অভাব কখনই হয় না।
৫) জ্ঞান – যিনি সর্বজ্ঞ।
৬) বৈরাগ্য – যিনি এই সংসার প্রপঞ্চে সম্পূর্ণরূপে অনাসক্ত।
এইটা হল সংক্ষেপে বিষ্ণু ও ভগবান শব্দগুলির সহজ ও সরল ব্যাখ্যা।
এই বিষ্ণুর উপাসক বৈষ্ণবদেরকে সাধুসমাজে বৈরাগী বলা হয়। এঁরা নিবৃত্তি মার্গী। যে মার্গ বা পথ অবলম্বন করলে জীব ভোগ থেকে মুক্তি পায় তাকে নিবৃত্তি মার্গ বলা হয়। শ্রী ভগবান জীবগণের নিমিত্ত দুটি মার্গ সৃষ্টি করেছেন। প্রবৃত্তি মার্গ ও নিবৃত্তি মার্গ। যারা লৌকিক বা পারলৌকিক কর্মফলের আশার দ্বারা প্রেরিত হয়ে কর্মানুষ্ঠান করেন তারা প্রবৃত্তিমার্গী। একটি উদাহরণ দ্বারা বলছি।
প্রাণীহিংসা করব না কারণ প্রাণীহিংসা করলে নরকে পতিত হতে হয় ; এই রকম মন করে অনেকেই শাস্ত্রের এই নিষেধাজ্ঞা মানে কারণ অবিধিপূর্বক প্রাণীহিংসা করলে নরকে পতিত হবে। উপস্থিত অতিথিদের আদর সৎকার করব বা অনেক রকমের দান-পুণ্য কাজ করব কারণ এইরূপ করে আমি স্বর্গাদি পারলৌকিক ফল পাব ; এই রকম মনে করে অনেকেই সৎকার্যে প্রবৃত্ত হয়। যারা এই ভাবে লৌকিক বা পারলৌকিক লাভ দ্বারা প্রেরিত হয়ে কর্মে প্রবৃত্ত হয় তাদেরকে প্রবৃত্তিমার্গী বলা হয়। এই জীব সকল বিস্মৃত হয়ে যায় যে তারা সচ্চিদানন্দরূপী ভগবদংশ। এই পরম সত্য জ্ঞান হারিয়ে তারা এই সংসারে জন্ম-মৃত্যুরূপ আবর্তে প্রবেশ করে সুখ-দুঃখাদি দ্বন্দ্ব ভোগ করতে থাকে এবং বারম্বার তাদেরকে এই সংসারে জন্ম গ্রহণ করতে হয়।
অপর দিকে, যে সকল জীব এই সমস্ত লৌকিক বা পারলৌকিক ফলের প্রতি লক্ষ্য না করে কেবল শাস্ত্রবিধিকে কর্তব্য বোধে পালন করে কর্ম করেন, যারা এই সংসারের বা পারলৌকিক সুখ-দুঃখের প্রতি লক্ষ্য না করে এই সংসার চক্রের জন্ম-মৃত্যু আবর্ত থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সদ্গুরুর আশ্রয় গ্রহণ করে নিজেকে সচ্চিদান্দরূপী ভগবদংশরূপে জানার জন্য প্রযত্ন করে তারা নিবৃত্তি মার্গী। এই সংসারে অনিত্য সুখভোগের প্রতি উদাসীন হয়ে এর থেকে নিবৃত্ত হয়ে মোক্ষাভিলাশী হয় বলেই এই সকল জীবকে নিবৃত্তিমার্গী বলা হয়। জ্ঞানমার্গী ও নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসক সন্ন্যাসীরাও নিবৃত্তি মার্গের পথিক। বৈরাগী সাধুরা ভক্তি মার্গী সগুণ-নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসক।
সাধারণতঃ সাধু এবং সন্ন্যাসী সকলকেই সন্ন্যাসী বলা হয় কারণ তাঁরা কর্মজীবনের আশ্রম চতুষ্টয়ের (ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ, বানপ্রস্থ, সন্ন্যাস) মধ্যে সন্ন্যাস-আশ্রম অবলম্বন করে থাকেন। প্রকৃত পক্ষে যাঁরা সন্ন্যাস আশ্রম গ্রহণ করেছেন তাঁরা সকলেই সন্ন্যাসী পরন্তু, যখন সাধু বা বৈরাগী বলা হয় তখন বুঝতে হবে যে তাঁরা বৈষ্ণব, এবং যখন সন্ন্যাসী বলা হয় তখন বুঝতে হবে যে তাঁরা জ্ঞান মার্গী, নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসকগণ। কিন্তু উভয়েই গৃহস্থাশ্রম ত্যাগ করে সন্ন্যাস আশ্রম গ্রহণ করেছেন বলে বুঝতে হবে।
এখন প্রকৃত বিষয় অর্থাৎ – নিম্বার্ক সম্প্রদায় সম্বন্ধে কিছু জানা প্রয়োজন। প্রথমে জেনে নিতে হবে যে সম্প্রদায় কাকে বলা হয়।
সম্যক্ প্রদীয়তে গুরুণা যত্র জ্ঞানং স সম্প্রদায়ঃ। অর্থাৎ – যেখানে সদ্গুরু দ্বারা সমস্ত তত্ত্বজ্ঞান দেওয়া হয় তাকে সম্প্রদায় বলে। সাধারণ ভাবে বলতে গেলে – সম্প্রদায় হচ্ছে একটি বিশেষ গোষ্ঠী যেখানে পরম্পরা প্রাপ্ত বিশেষ সিদ্ধান্ত, তত্ত্বজ্ঞান ও ব্রহ্মবিদ্যা সম্বন্ধে শিক্ষা প্রদান করা হয়। সাধনায় সিদ্ধি লাভ করতে হলে সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়া আবশ্যক। অর্থাৎ, মন্ত্র গ্রহণ করতে হলে সদ্গুরুর নিকট পরম্পরা প্রাপ্ত সিদ্ধ মন্ত্র গ্রহণ করলে সাধনায় সিদ্ধি লাভ হবে, অন্যথা নয়। কারণ শাস্ত্রে বলা হয়েছে – সম্প্রদায়বিহীনাযেমন্ত্রাস্তেনিষ্ফলামতাঃ। (পদ্মপুরাণ) অর্থাৎ – সম্প্রদায়বিহীন ফল নিষ্ফল হয়।
পুরাণ আবার বলছেন –
অতঃ কলৌভবিষ্যন্তি চত্বারঃ সম্প্রদায়িনঃ।
শ্রীব্রহ্মরুদ্রসনকা বৈষ্ণবাঃ ক্ষিতিপাবনাঃ।। (নারদ পঞ্চরাত্র)
অর্থাৎ – শ্রী, ব্রহ্ম, রুদ্র,সন্, এই চারটি ক্ষিতি পাবক বৈষ্ণব সম্প্রদায় কলিযুগে হবে।
এই চারি সম্প্রদায়ের আদি চার আচার্য সম্বন্ধে বলা হয়েছে –
রামানুজং শ্রীশ্চক্রে মাধ্বাচার্য্যং চতুর্মুখঃ।
শ্রীবিষ্ণুস্বামিনং রুদ্রো নিম্বাদিত্যং চতুঃসনঃ।। (নারদ পঞ্চরাত্র)
অর্থাৎ – শ্রীমৎ রামানুজ স্বামী শ্রী সম্প্রদায়ের আচার্য। শ্রীমৎ স্বামী মাধ্বাচার্য ব্রহ্ম সম্প্রদায়ের আচার্য, শ্রীমৎ বিষ্ণুস্বামী রুদ্র সম্প্রদায়ের আচার্য এবং শ্রীমৎ স্বামী নিম্বাদিত্য স্বামী চতুঃসন্ সম্প্রদায়ে আচার্য হন।
কালের প্রভাবে এই সম্প্রদায়গুলির নাম পরিবর্তিত হয় এবং সকল সম্প্রদায়েরই বিভিন্ন শাখা সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে পূর্বের “শ্রী” সম্প্রদায় এখন “রামানুজী” নামে পরিচিত, “ব্রহ্ম” সম্প্রদায় এখন “মাধ্বি” নামে জানা যায়, “রুদ্র” সম্প্রদায় এখন “বিষ্ণুস্বামী” নামে প্রচলিত, এবং “সন্” সম্প্রদায়ের অধুনা নাম হচ্ছে “নিম্বার্ক” সম্প্রদায়। রামানুজীর শাখা রামানন্দী, মাধ্বির শাখা গৌড়িয়, গৌরেশ্বর ইত্যাদি, বিষ্ণুস্বামীর বল্লভ এবং নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের হরিব্যাসী প্রভৃতি শাখার সৃষ্টি হয়েছে।
আমরা নিম্বার্ক সম্প্রদায় ভুক্ত বৈষ্ণব। সৃষ্টির প্রারম্ভেই এই সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয় এবং শ্রীনিম্বার্ক ভগবান, যিনি আমাদের সম্প্রদায়ের চতুর্থ গুরু, তাঁর নামে এই সম্প্রদায় এখন প্রচলিত ও বিখ্যাত। এবার আমরা এই সম্প্রদায়ে গুরু পরম্পরার প্রসঙ্গে কিছু মৌলিক তথ্য জানব।