এই সম্প্রদায়ের প্রথম গুরু হচ্ছেন শ্রীহংস ভগবান, যিনি স্বয়ং ভগবান বিষ্ণুর চব্বিশটি অবতারের মধ্যে একজন। সৃষ্টির প্রারম্ভে সত্যযুগে ভগবান বিষ্ণু স্বয়ং নিজে চতুর্ভুজ রূপ ধারণ করে শঙ্খ, চক্র, গদা, ও পদ্ম যুক্ত হয়ে হংসাবতার নামে ব্রহ্মার মানসপুত্র সনকাদি ঋষিদের নিকট অবতীর্ণ হয়েছিলেন। শ্রীমদ্ভাগবতে কথিত আছে যে ব্রহ্মা নিজের মানসপুত্র, সনক, সনন্দ, সনৎকুমার ও সনাতন, এই চারিজনকে সৃষ্টি করে প্রজা বিস্তার করার উপদেশ দিলেন। কিন্তু তাঁরা সংসার প্রপঞ্চে লিপ্ত হতে অনিচ্ছুক ছিলেন সেই জন্য তাঁরা পিতা ব্রহ্মার নিকট এই সংসার প্রপঞ্চ থেকে মুক্ত হওয়ার উপদেশ যাচনা করলেন। পিতা ব্রহ্মা তখন সৃষ্টি কার্যে ব্যস্ত হওয়াতে প্রবল রজোগুণের দ্বারা অভিভূত ছিলেন সেই জন্য তিনি সনকাদি ঋষিগণকে ব্রহ্মবিদ্যা সম্বন্ধে উপদেশ প্রদান করতে অসমর্থ হলেন। তখন তিনি এই কার্যের জন্য ভগবান বিষ্ণুর ধ্যান করে তাঁকে আহ্বান করেছিলেন। শ্রীভগবান তখন হংসাবতার রূপে অবতীর্ণ হয়ে সনকাদি ঋষিগণকে ব্রহ্মবিদ্যা সম্বন্ধে উপদেশ করে মুক্তির মার্গে প্রেরিত করেছিলেন। এই সম্বন্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভাগবতে উদ্ধবকে বলেছেন –
তস্যাহং হংসরূপেণ সকাশমগমং তদা। (শ্রীমদ্ভাগবৎ, ১১।১৩।১৯)
অর্থাৎ – তখন আমি হংসরূপ ধারণ করে তাঁর নিকট উপস্থিত হয়েছিলাম। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পুনরায় বললেন –
জানীত মাগতং যজ্ঞং যুষ্মদ্ধর্মরিবক্ষয়া। (শ্রীমদ্ভাগবৎ, ১১।১৩।৩৮)
অর্থাৎ – তোমাদের ধর্ম উপদেশ করার জন্য হংসরূপে আগত আমাকে বিষ্ণু বলে অবগত হও(সনকাদি ঋষিকে হংস ভগবান বলছেন)।
তিনি যে সত্য যুগে ভগবদাবতার ছিলেন তার উল্লেখ শ্রীমদ্ভাগবতে অন্যত্র পাওয়া যায়।
কৃতে শুক্লশ্চতুর্বাহুর্জটিলো বল্কলাম্বরঃ।
কৃষ্ণাজিনোপবীতাক্ষান্ বিভ্রদ্দন্ড কমন্ডলু।।
হংসঃ সুপর্ণো বৈকুন্ঠো ধর্মো যোগেশ্বরোঽমলঃ।
ঈশ্বরঃ পুরুষোঽব্যক্তঃ পরমাত্মেতি গীয়তে।। (শ্রীমদ্ভাগবৎ, ১১।৫।২১,২৩)
অর্থাৎ – সত্যযুগে শ্রীভগবান শুক্লবর্ণ, চতুর্বাহু, জটাযুক্ত, বল্কল বস্ত্র পরিধারী, কৃষ্ণসার মৃগচর্ম, উপবীত, অক্ষমালা ও দন্ড, এবং কমন্ডলুধারী হন। উক্ত সত্য যুগে শ্রীভগবান হংস, সুপর্ণ, বৈকুন্ঠ, ঈশ্বর, পুরুষ, অব্যক্ত, ও পরমাত্মা ইত্যাদি নামে কীর্তিত হন।
গোপাল সহস্রনাম এবং বিষ্ণুসহ্স্রনাম স্তোত্রদ্বয়েও শ্রীভগবানের একটি নাম “হংস” বলে উল্লেখিত আছে। যথা –
অচ্যুতঃ কেশবো বিষ্ণুর্হরিঃ সত্যো জনার্দনঃ।
হংসো নারায়ণো লীলো নীলো ভক্তি পরায়ণঃ। (গোপালসহস্রনাম, ৭৫)
মরীচির্দমনো হংসঃ সুপর্ণো ভুজগোত্তমঃ।
হিরণ্যনাভঃ সুতপাঃ পদ্মনাভঃ প্রজাপতি।। (বিষ্ণুসহস্রনাম, ২১)
হংস শব্দের অর্থ হচ্ছে –
হংসো যথা ক্ষীরনীরবিবেচনে শক্তস্তথাঽসৌ সার্বজ্ঞ্যাদ্যনন্তগুণশক্ত্যাদিমত্ত্বেন জনজ্জ্ন্মাদিব্যাপারকর্ত্তৃত্বা-
চ্চেতনাচেতনয়োর্বিবেচননৈপুণ্যবানিতি। (মন্ত্ররহস্যটীকা)
হংস যেমন দুধ ও জলের পার্থক্য বুঝতে সক্ষম, সেই রকম এই হংসও যিনি সর্বজ্ঞত্ব আদি অনন্ত গুণ বিশিষ্ট এবং জগতের সৃষ্টি আদির ব্যাপারের কর্তা হওয়াতে তিনি চেতন (আত্মা) ও অচেতনের (বিনশ্বর জগতের) প্রভেদ বুঝতে নিপুণ।সরল ভাষায় বলতে গেলে – হংস যেমন দুধ ও জলের মিশ্রণ থেকে জল পরিত্যাগ করে সার পদার্থ দুধকে গ্রহণ করে তদ্রূপ এই হংস বিষয় ও ইন্দ্রিয়রূপী জগতের সাথে জড়িত আত্মা থেকে বাহ্যিক অসার অচেতন জগৎকে পৃথক করে তার অন্তরনিহিত চেতন স্বরূপ সার আত্মাকে গ্রহণ পূর্বক আত্মজ্ঞানের উপদেশাদি প্রদান করতে সমর্থ।
হংস শব্দের অন্য একটি ব্যাখ্যায় বলা হয় – হন্তীতি হংস (হন্তি ইতি হংস)। “হন্তি”র অর্থ হনন করা বা নাশ করা গ্রহণ করলে হংস শব্দের অর্থ দাঁড়ায় – “সোঽহম্” অর্থাৎ – “আমি সেই”, এই ভাবের উপাসকের সংসার বন্ধন বা ভীতি যিনি হনন করেন বা নাশ করেন তিনিই হংস।
ভগবান শ্রীবিষ্ণুর অবতার হংস ভগবান সত্যযুগে অবতীর্ণ হয়ে সনকাদি ঋষিগণকে মোক্ষপ্রদ ব্রহ্মবিদ্যা প্রদান করে আমাদের সম্প্রদায়ে সর্বপ্রথম ও সর্বাদি সদ্গুরুর স্থান অধিকার করেছিলেন।