আমাদের সম্প্রদায়ের ৫৪তম আচার্য, শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী রামদাস কাঠিয়া বাবাজী মহারাজ, সর্বত্র কাঠিয়া বাবা নামে বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর জন্ম প্রায় দুইশত বছর পূর্বে পাঞ্জাব রাজ্যের লোনাচামারী গ্রামে হয়। ব্রাহ্মণ বংশ জাত এই মহাত্মার সঠিক জন্ম ও সাল আদি জানা নাই তবে, আমার পরদাদাগুরুজী মহারাজ, শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী সন্তদাসজী মহারাজ বলেছিলেন যে গুরু পূর্ণিমা অর্থাৎ, আষাঢ়ী পূর্ণিমার পবিত্র দিনে শ্রীশ্রী কাঠিয়া বাবাজী মহারাজের জন্ম হয়। তদবধি আমরা গুরুপূর্ণিমাতেই কাঠিয়া বাবাজী মহারাজের আবির্ভাব উৎসব পালন করি।
তিনি তাঁর মাতা-পিতার তৃতীয় পুত্র এবং তাঁদের, বিশেষ করে মায়ের অত্যন্ত স্নেহের পাত্র ছিলেন। চার বছর বয়সে গ্রামবাসী একজন পরমহংস সাধক তাঁকে সর্বদা রাম নাম জপ করতে উপদেশ দেন। সেই সময় থেকে তিনি রাম নাম জপের অভ্যাস করতে লাগলেন। তাঁর বয়স যখন ৫/৬, একদা মাঠে মহিষ চরাতে চরাতে তিনি একজন উজ্জ্বলকান্তি সাধু পুরুষের দর্শন লাভ করলেন। সাধুজী তাঁর নিকট কিছু আহার যাচনা করলে, কাঠিয়া বাবাজী মহারাজ নিজ গৃহ থেকে প্রচুর পরিমানে ময়দা, চিনি, ঘি, আদি তাঁকে এনে দিলেন। সাধু প্রসন্ন হয়ে তাঁকে বরদান করলেন যে, “তুমি যোগীরাজ হবে।” এই বরদান করে সাধু অন্তর্হিত হলেন। তখন সেই সময় কাঠিয়া বাবাজী মহারাজের মনে হল যেন সংসারের প্রতি তাঁর সমস্ত আসক্তি কেটে গেছে। অতঃপর উপনয়ন সংস্কার হলে তিনি অন্য গ্রামে গুরুর নিকট শাস্ত্র অধ্যয়ন করতে লাগলেন। সেখানে তিনি ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, শাস্ত্র, স্মৃতি, বিষ্ণুসহস্রনাম, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা প্রভৃতি শিক্ষা করলেন। এই সকল গ্রন্থের মধ্যে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা তাঁর সর্বাধিক প্রিয় ছিল। গুরুগৃহ থেকে প্রত্যাবর্তন করে তিনি গ্রামের একটি বটবৃক্ষের তলায় বসে গায়ত্রী মন্ত্রে সিদ্ধি লাভের জন্য জপ করতে লাগলেন এবং শেষে তিনি গায়ত্রীতে সিদ্ধি লাভও করলেন। গায়ত্রীদেবী আবির্ভূত হয়ে তাঁকে দর্শন দিয়ে কৃতার্থ করলেন। গায়ত্রী মন্ত্র জপ করার সময় শেষ অবশিষ্ট পঁচিশ হাজার জপ জ্বলামুখীতে সম্পূর্ণ করার নির্দেশ তিনি দৈববাণী দ্বারা প্রাপ্ত হলেন। তিনি কাল বিলম্ব না করে জ্বালামুখীর উদ্দেশ্যে রাওনা হলেন। পথে অতি তেজপুঞ্জ কলেবর, বিরাট জটা-জুটধারী এক সাধুকে তিনি দর্শন করে তাঁর প্রতি ভীষণ ভাবে আকৃষ্ট হলেন ও তৎক্ষণাৎ তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করে তার কাছে দীক্ষা ও সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন। সেই সাধু ছিলেন আমাদের সম্প্রদায়ের ৫৩ম আচার্য, শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী দেবদাসজী কাঠিয়া বাবাজী মহারাজ। শ্রীশ্রী দেবদাসজী মহারাজ ছিলেন যোগীশ্বর সিদ্ধ মহাপুরুষ। তিনি ছয় মাস কাল একাসনে সমাধিস্থ হয়ে থাকতেন এবং সমাধিতে না থাকলেও তাঁর আহার কিছুই ছিল না।
সন্ন্যাস গ্রহণের পর কাঠিয়া বাবার নামকরণ হল, “রামদাস”। গুরুর সন্নিধানে থেকে তিনি সর্বতোভাবে গুরুসেবায় নিযুক্ত থাকতেন। তাঁর গুরুদেব তাঁকে হঠযোগের সঙ্গে অষ্টাঙ্গযোগ, সর্ব বিধ মন্ত্র এবং তাদের প্রয়োগ প্রণালী শিক্ষা দিতে লাগলেন। গুরুদেব কিন্তু শিষ্যকে মাঝে মাঝে পরীক্ষা করতেও ত্রুটি করতেন না। কখনো অনাহারে রাখতেন, কখনো খুব সুস্বাদু আহার করাতেন, কখনো অশ্রাব্য গালাগাল দিয়ে বা অকারণে মারধোড় করে শ্রীশ্রী রামদাসজীর পরীক্ষা নিতেন। একবার শ্রীশ্রী দেবদাসজী তাঁকে এক আসন দেখাইয়া তাঁকে সেইখানে উপবিষ্ট হতে বললেন, তাঁকে নির্দেশ দিলেন যে, “যত ক্ষণ না আমি ফিরে আসি তুমি এখানে এই আসনে বসে থাকবে। আসন ছেড়ে অন্য জায়গায় কোথাও যাবে না।” গুরুদেব যে গেলেন ত এলেন আট দিন পরে। শ্রীরামদাসজী আট দিন একটানা সেই আসনে বসে রইলেন, কিছু আহার করলেন না, মল-মুত্র ত্যাগও করলেন না। অষ্টম দিনে গুরুদেব ফিরে এলে শ্রীরামদাসজী আসন থেকে উঠে গুরুদেবকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেন। তাঁর গুরু আজ্ঞা পালনের প্রতি এই একনিষ্ঠতা ও দৃঢ়তা দেখে গুরুদেব খুব প্রসন্ন হয়ে বললেন, “এই ভাবেই গুরুর আদেশ পালন করতে হয়। গুরুর আদেশ কায়মনোবাক্যে পালন করলে ভগবান প্রসন্ন হন।”
এই ভাবে বহু বছর গুরুর সান্নিধ্যে কাটিয়ে তিনি গুরুকে সেবায় সন্তুষ্ট করে তাঁর নিকট সর্ব সিদ্ধির বর প্রাপ্ত হলেন। কিন্তু তার পূর্বে গুরুদেব একটি শেষ পরীক্ষা করলেন। একদিন হঠাৎ ক্রোধের ভান করে অকারণে তিনি শ্রীরামদাসজীকে বেদম পেটাতে লাগলেন, চিমটা আদি দিয়ে এমন মারতে লাগলেন যে শ্রীরামদাসজীর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ফুলে উঠল। মারতে মারতে তিনি বললেন, “তুই কেন আমার পিছনে পড়ে আছিস্, আমার সব বড় বড় চেলা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, তুইও চলে যা। আমি কারুর সেবা চাই না।” শ্রী রামদাসজী মহারাজ সমস্ত কিছু নির্বিকার চিত্তে সহ্য করলেন আর শেষে গুরুদেবকে বিনীত ভাবে বললেন, “মহারাজ, আমি আপনাকে সাক্ষাৎ ভগবান মনে করি, সেই জন্য আপনাকে ছেড়ে ত আমি কোথাও যাব না। তবে এই রকমও আর সহ্য করতে পারছি না। আমি আপনাকে ছুরি দিচ্ছি আপনি আমার গলা কেটে নিন্, কিন্তু প্রাণ থাকতে ত আমি আপনাকে ছেড়ে অন্য কোথাও যাব না।” শিষ্যের এই বিনীত ও আর্ত কথাগুলি শুনে গুরুদেব প্রসন্ন হয়ে বললেন, “আজকে তোমাকে আমি শেষ বার পরীক্ষা করলাম, তোমার সেবায় ও গুরুভক্তিতে আমি প্রসন্ন হয়েছি। আমি বরদান করছি যে তোমার সর্বাভীষ্ট সিদ্ধ হবে, তুমি ইষ্টদেবের সাক্ষাৎকার পাবে,” ইত্যাদি বহু বর শ্রীরামদাসকে প্রদান করলেন। কিছুকাল পরে শ্রী দেবদাসজী মহারাজ লীলা ছলে ত্যাগ করলেন এবং গুরুদেবের তিরোধানের পর শ্রীশ্রী রামদাসজী মহারাজ কঠোর তপস্যাচরণ করতে লাগলেন। গ্রীষ্মকালে তিনি পঞ্চধুনী তাপতেন এবং শীতকালে জলাশয়ে দাঁড়িয়ে সমস্ত রাত্রি জপ করতেন। ভরতপুর সয়লানির কুন্ড নামক এক কুন্ডের সমীপে তিনি ইষ্টদেবের সাক্ষাৎকার লাভ করেন এবং পূর্ণরূপে সিদ্ধ মনোরথ হলেন। এই সম্বন্ধে তিনি নিজেই বলতেন –
রামদাস কো রাম মিলা সয়লানিকি কুন্ডা।
শন্তন তো সচ্চি মানে ঝুঁট মানে গুন্ডা।।
সাধনায় সিদ্ধ মনোরথ হওয়ার পর শ্রীশ্রী কাঠিয়া বাবাজী মহারাজ পদব্রজে ভারতের সকল তীর্থ ভ্রমণ করেন। পরে তিনি বৃন্দাবনে স্থায়ীরূপে বাস করতে লাগলেন। প্রথমে দাবানল কুন্ডের উপরিস্থিত আখড়ায় কিছু দিন আসন লাগালেন এবং তার পরে গঙ্গাকুঞ্জের যমুনা ঘাটে বাস করতে লাগলেন। পরে ছিন্নু সিংহ নামক এক গৌতম বংশীয় ব্রাহ্মণ ব্রজবাসী পালওয়ানের অনুরোধে কেমারবনে থাকতে লাগলেন। ছিন্নু সিং শ্রীশ্রী রামদাসজীকে রেললাইনের নিকট সেই স্থানটি অর্পণ করলেন। সেই স্থানে একটি আশ্রম হয় যেটা “কাঠিয়া বাবা কা পুরানা স্থান বলে এখনো পরিচিত ও প্রসিদ্ধ আছে।
বৃন্দাবনে গঙ্গাকুঞ্জের ঘাটে বাসকালে ছিন্নু সিং একদিন শ্রীশ্রীরামদাসজীকে একটি ব্যক্তিকে দেখিয়ে বললেন, “বাবাজী মহারাজ, আপনি এই চোরকে সংশোধন করুন। এই চোরটি ব্রজবাসী ব্রাহ্মণ কিন্তু এমন পাষন্ড যে চতুর্দশ বছর দ্বীপান্তে কারাদন্ড ভোগ করেও এর কোনও রকম পরিবর্তন হয়নি। এর অত্যাচার থেকে সকলকে মুক্ত করুন।” শ্রীশ্রীরামদাসজী সেই “গোসাঞা” নামক ডাকাতের সর্দারকে সেই দিনই দীক্ষা দান করলেন । শ্রীশ্রী কাঠিয়া বাবাজী মহারাজের অনুকম্পায় সেই অত্যাচারী ডাকাত পরে এক প্রেমিক সাধুরূপে পরিণত হল।
শ্রীশ্রীরামদাসজী নিজের গুরু প্রদত্ত কাষ্ঠের আড়বন্ধ ও কৌপীন ধারণ করতেন ও অঙ্গে বিভূতি (সাধুদের ধুনির ভস্ম) মেখে থাকতেন। কাষ্ঠের কৌপীন ও আড়বন্ধের জন্য তাঁকে সকলেই “কাঠিয়া বাবা” বলতেন। এই কাষ্ঠ কৌপীন ও আড়বন্ধের প্রচলন তাঁর চেয়ে উর্দ্ধতন চতুর্থ আচার্য, শ্রীশ্রী ইন্দ্রদাসজী আরম্ভ করেছিলেন। কিন্তু তা হলেও শ্রীশ্রীরামদাস কাঠিয়া বাবাজী মহারাজ থেকেই “কাঠিয়া বাবা”,এই নামটি প্রসিদ্ধ হয়েছে। সারা ভারতে নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের মত “কাঠিয়া পরিবার”ও প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। সেই জন্য এখন সাধু অথবা গৃহস্থ সমাজে আমরা “কাঠিয়া পরিবার” ভুক্ত, এই পরিচয়েও আহুত হয়ে থাকি।
শ্রীশ্রী কাঠিয়া বাবাজী মহারাজের জন্যই বাংলা রাজ্যে নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের ভিত পড়েছিল। তিনি অনেক বাঙ্গালী শিষ্য-শিষ্যাদের দীক্ষা প্রদান করে যেন বাংলায় নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের ভগীরথী হয়ে এসেছিলেন। তারপরে লক্ষ লক্ষ লোক এই সম্প্রদায়ে আশ্রয় লাভ করে মুক্তি পথে এগিয়ে চলেছে। তাঁরা এই সম্প্রদায়ের বিভিন্ন আচার্যগণের আশ্রিত হলেও তাঁরা সকলেই পরমপদ পাওয়ার অধিকার লাভ করেছে।
শ্রীশ্রী কাঠিয়া বাবাজী মহারাজ ব্রজভূমির “ব্রজবিদেহী মহন্ত” এবং কুম্ভ মেলার বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের “শ্রীমহন্ত” পদেও আসীন ছিলেন। তিনি ছিলেন এক অসীম শক্তিশালী যোগীরাজ বৈষ্ণবাচার্য। শ্রী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বলেছিলেন যে, শ্রীশ্রী কাঠিয়া বাবাজী মহারাজ প্রাচীন যুগের গর্গ, নারদ ইত্যাদি মুনি-ঋষিদের শ্রেণীভুক্ত ছিলেন। তিনি দেহে থাকাকালীন নিজেরই ছবি থেকে বহির্গত হয়ে একজনকে দীক্ষা দিয়েছিলেন। আকাশমার্গে বৃন্দাবন থেকে কলকাতায় আগমন করে অপর একজনকে মন্ত্র প্রদান করেছিলেন। তিনি এক কালে দুই পৃথক স্থানে ভক্তদের দর্শন দান করতে সমর্থ ছিলেন। শুধু তাই নয়, এখনো পর্যন্ত তিনি কোন কোন ভক্তকে প্রত্যক্ষদর্শন প্রদান করে থাকেন। তাঁর জীবনের সম্পূর্ণ বিবরণ এই স্থানে দেওয়া অসম্ভব। ১৩১৬ বঙ্গাব্দে ৮ই মাঘের ভোর রাত্রে এই মহাপুরুষ স্বেচ্ছায় যোগাসনে স্থিত হয়ে নিজ মানবলীলা সম্বরণ করলেন।
শ্রীশ্রীকাঠিয়াবাবাষ্টকম।
কমণ্ডলুকরকমলায় তপোদীপ্তকান্তয়ে।
কাঠিয়াবাবাখ্যায় শ্রীরামদাসায় তে নমঃ।।১।।
নিম্বার্ককুলতিলকায় মনোহররূপিণে।
শ্রীদেবদাসশিষ্যায় শ্রীরামদাসায় তে নমঃ।।২।।
নমো নারদর্ষিসনকাদিককৃপাশিতায়।
কাঠিয়াপরিবারপ্রসিদ্ধিপ্রদায়িনে নমঃ।।৩।।।
সব্বেষ্টবরদে শ্রীমহান্তব্রজবিদেহিনে।
ভক্তজনপূজিতায় মুনীন্দ্রায় নমো নমঃ।।৪।।।
ব্রজরজাঙ্গরাগায় ত্রয়তাপাপহারিণে।
কল্পদ্রুমস্বরূপায় শ্রীরামদাসায় তে নমঃ।।৫।।
যমুনাতটনিবাসায় ব্রজধামবিহারিণে।।
নমঃ কল্যাণরূপায় শ্রীরামদাসায় তে নমঃ।।৬।।
নমঃ শরণাৰ্ত্তবান্ধবায় করুণাসিন্ধবে নমঃ।
নমঃ পাপপ্রণাশায় শ্রীরামদাসায় তে নমঃ।।৭।।
পরব্রহ্মস্বরূপায় পরাভক্তিপ্রদায়িনে।
অনন্তবিশ্বরূপায় শ্রীরামদাসায় তে নমঃ।।৮।।
সভক্ত্যা স্তোত্রমিদং শ্রীকাঠিয়াবাবাষ্টকম্।
দাসানুদাসেন কৃষ্ণদাসেন বিরচিতম্।।
শ্রদ্ধাভক্তিসমন্বিতঃ যঃ পঠেনিত্যং স্তোত্রমিদম্।
লভতে স পরাভক্তিং বৈকুণ্ঠধাম তস্য নিশ্চিতম্।।
ইতি কৃষ্ণদাসেন বিরচিতং শ্রীশ্রীকাঠিয়াবাবাষ্টকম্ সমাপ্তম্।।