এই সম্প্রদায়ের ৫৬তম আচার্য আমার পরমপূজ্য দাদাগুরুজী শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী প্রেমদাস কাঠিয়া বাবাজী মহারাজ। বর্তমান বাংলাদেশের শ্রীহট্ট জেলার কাশীপুর গ্রামে ১৯১৩ খৃষ্টাব্দে দুর্গাপূজোর মহাসপ্তমী তিথিতে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর নাম ছিল শ্রীপ্রিয়নাথ ভট্টাচার্য। বাল্যকাল থেকেই সংসারের প্রতি তাঁর ছিল উদাসীন ভাব। সিদ্ধ পুরুষ হব – এই ছিল তাঁর সংকল্প। হরি নাম তাঁর খুব প্রিয়। লেখা পড়ায় খুব একটা মন বসত না। মিডিল ইংলিশ স্কুল পাশ করার পরে আর তিনি হাই স্কুল পড়েন নি।
প্রায় ২০ বছর বয়সে তিনি শ্রীহট্ট থেকে হাওড়ার শিবপুরের নিম্বার্ক আশ্রমে এসে শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী সন্তদাসজী মহারাজের নিকট দীক্ষা ও সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। সাধারণতঃ শ্রীশ্রী সন্তদাসজী মহারাজ চার-ছয় মাস এমন কি কখনো কখনো এক-দুই বছর পর্যন্ত পরীক্ষার পর সন্ন্যাস দিতেন পরন্তু মাত্র ২/৩ দিনের মধ্যেই তিনি শ্রীপ্রিয়নাথ ভট্টাচার্য়কে দীক্ষা ও সন্ন্যাস প্রদান করে তাঁর নতুন নামকরণ করলেন, “প্রেমদাস”। সেই দিনও ছিল দুর্গা সপ্তমী।
কিছুকাল পরে তিনি বৃন্দাবন গেলে তাঁর গুরুদেব তাঁকে বিধিপূর্বক কাষ্ঠ আড়বন্ধ ও কাষ্ঠলেঙ্গট ধারণ করালেন। শিবপুরে তিনি পূজারীর কার্যে নিযুক্ত হলেন। বৃন্দাবনে এলে তাঁকে রান্না করা, পরিবেশন করা, আদি কার্যও দেওয়া হত। নিজ গুরুদেবের নিকট অবস্থান করে এবং শিক্ষা লাভ করে তিনি অতি শীঘ্র সর্ব কর্মে দক্ষ হয়ে উঠলেন।
তাঁর গুরুদেবের দেহরক্ষার পর তাঁর বৈরাগ্য তীব্রতর হলে তিনি আশ্রম ত্যাগ করে কঠোর তপস্যা করার জন্য ব্রজধামে উপযুক্ত স্থান খুঁজতে লাগলেন। শেষে কদমখন্ডীর পাহাড়ে যে স্থানে শ্রীশ্রীনাগাজী মহারাজ সিদ্ধি লাভ করেছিলেন, সেই গুহার ভিতর তিনি তীব্র তপস্যায় ব্রতী হলেন। মৌন ব্রত অবলম্বন করে অনাহারে, শুধু মাত্র এক কমন্ডলু জল নিয়ে সেই গুহায় প্রবেশ করলেন। তখন তিনি দিবারাত্রি জপ করতেন। সেই জল শেষ হলে অনাহারে নিরম্বু হয়েই জপ-ধ্যান তাঁর চলতে লাগল। প্রায় পনের দিন পর তিনি শ্রীভগবানের কৃপা অনুভব করলেন এবং ভগবদ্দর্শন পেলেন। তার পর আরও দশ দিন তিনি তাঁর তীব্র তপস্যা জারি রাখলেন। তার পর তিনি তাঁর সর্বাভীষ্ট লাভ হয়েছে বলে অনুভব করলেন।
ঈশ্বর সাক্ষাৎকার এবং পূর্ণ সিদ্ধ মনোরথ হবার পর বৃন্দাবনের নিম্বার্ক আশ্রমে প্রত্যাবর্তন করে পরম শান্তিতে থাকতে লাগলেন। পূর্ববৎ সেখানে তিনি শ্রীশ্রীঠাকুরজীর শৃঙ্গার সেবা এবং আরতি করতে লাগলেন। সেই সময় শ্রীশ্রীঠাকুরজী ও শ্রীশ্রী রাধারানীজী প্রত্যহ পূর্ব দিন রাত্রে তাঁকে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে নির্দেশ দিয়ে দিতেন যে কোন কোন পোষাক দ্বারা কিরূপে শৃঙ্গার করতে হবে। তিনিও মহানন্দে স্বপ্নাদিষ্ট পোষাক দ্বারা যুগল শ্রীবিগ্রহের শৃঙ্গার করতেন। তিনি আশ্রমে অন্যতম পূজারীরূপে বহু কাল অতিবাহিত করেছিলেন। সেই সময় ভোর তিনটের সময় তাঁর সামনে দুইবার শ্রীশ্রীঠাকুরজী প্রকট হয়েছিলেন। প্রথমবার শ্রীশ্রী ঠাকুরজী বললেন, “খুব ঠান্ডা লাগছে”, এবং দ্বিতীয় বার বললেন, “খুব মশা, খুব মশা।” আশ্রমের লেপ পুরাতন হয়ে ছিঁড়ে যাওয়াতে সেই সময় সেটা ব্যবহার হচ্ছিল না এটা জানার পর তিনি নতুন লেপ তৈরী করিয়ে শ্রীশ্রী ঠাকুরজীকে দেন। সেই রকমই, যখন দ্বিতীয় বার দর্শন হয় তখন শ্রীশ্রী ঠাকুরজীর মশারি ছিঁড়ে গেছিল এবং সেই জন্য ব্যবহার হত না। সেই বার তিনি নতুন মশারি তৈরী করিয়ে শ্রীশ্রী ঠাকুরজীকে দেন।
মাঝে মাঝে তিনি তীর্থ দর্শনে যেতেন। একবার দক্ষিন ভারতে তীর্থ করার সময় তিনি এক জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কয়েকজন সাধুদের সঙ্গে যাচ্ছিলেন। সেই সময় এক বাঘ তাঁদের সম্মুখে চলে এল। তিনি সর্বাগ্রে ছিলেন কিন্তু বাঘ তাঁদের কোন রকম ক্ষতি না করেই পথ ছেড়ে নিঃশব্দে জঙ্গলের ভিতরে অন্য দিকে চলে গেল। অমরনাথজীকে দর্শন করার পরে প্রত্যাবর্তন করার সময় শেষনাগের সরোবরে তিনি শেষনাগের সাক্ষাৎ দর্শন পেয়েছিলেন। নেপালে মুক্তি নারায়ণ দর্শন করার সময় তিনি সেখানে সোওয়া লক্ষ জপের অনুষ্ঠান করেছিলেন। সেই সময় একদিন ভোর রাত্রে তাঁর গুরুদেব, শ্রীশ্রী সন্তদাসজী মহারাজ তাঁকে সাক্ষাৎ দর্শন দিলেন। তিনি মহানন্দে গুরুদেবকে প্রণিপাত করে তাঁকে সাদরে আসনে বসালেন। প্রায় আধ ঘন্টা গুরুদেবের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হল এবং তার পরে শ্রীশ্রী সন্তদাসজী মহারাজ হিমালয়ের দিকে উত্তরের আকাশে পথে যেতে যেতে অন্তর্হিত হয়ে গেলেন। গুরুদেবের তিরোধানের বহু বছর পর এইরূপ সশরীরে তাঁর সাক্ষাৎ পেয়ে তিনি খুব আনন্দিত হয়েছিলেন।
বৃন্দাবন থেকে তিনি শ্রীহট্টের নিম্বার্ক আশ্রমে যান এবং সেখানে তিনি বহুদিন ছিলেন। শ্রীহট্ট থেকেই তিনি দীক্ষা প্রদান করতে আরম্ভ করেন। খুব কম সময়ের মধ্যে তাঁর বহু শিষ্য–শিষ্যা সেখানে হয়।
১৯৫৩ সালের আগষ্ট মাসে বৃন্দানের নিম্বার্ক আশ্রমের মহন্ত পদে ও ব্রজ চৌরাশী ক্রোশের ব্রজবিদেহী মহন্ত পদে তাঁকে অভিষিক্ত করা হয়। ১৯৫৪ ইং সালের জানুয়ারী মাসে প্রয়াগরাজের কুম্ভ মেলায় তাঁকে বৈষ্ণব চতুঃসম্প্রদায়ের শ্রীমহন্ত পদে সমস্ত সাধুগণ মিলে অভিষিক্ত করলেন। দীর্ঘ চৌদ্দ বছর তিনি বৃন্দাবনের নিম্বার্ক আশ্রমের পদে আসীন ছিলেন। ১৯৬৭ ইং সালে সেই পদ ত্যাগ করে তিনি হওড়ার শিবপুর আশ্রমে চসে এলেন।
ইং ১৯৬৯ সালে তিনি শিবপুর নিম্বার্ক আশ্রমের মহন্ত পদ প্রাপ্ত হন। সেখানে থাকাকালীন তিনি দুই বার চাতুর্মাসিক গোপাল মন্ত্রজপের অনুষ্ঠান ও বিষ্ণু যজ্ঞ করেন। ইং ১৯৭২ সালে বংলাদেশের শ্রীহট্টে গিয়ে সেখানকার নিম্বার্ক আশ্রমে – ভগ্ন বিগ্রহ সরিয়ে – জয়পুরে নির্মিত বিগ্রহ যুগল যজ্ঞাদি শাস্ত্রবিধি অনুষ্ঠান দ্বারা প্রতিষ্ঠা করলেন। সেই বিগ্রহ এখনও পূজিত হন।
সেবা ও পূজার মধ্যে তিনি সেবাকেই প্রাধান্য দিতেন। দাস-দাসীদের সেবাই সর্বপ্রথম কর্তব্য। তিনি সানন্দে সাধু সেবা, ভক্ত সেবা, পীড়িত জনের সেবা করতেন। যেখানে সেবা করতে বাধা পেতেন সেই স্থান, সেই পদ, সমস্ত ত্যাগ করতে দ্বিধা বোধ করতেন না। তিনি যখন বৃন্দাবনের নিম্বার্ক আশ্রমের মহন্ত ছিলেন সেই সময় প্রচুর পরিমানে সাধু সেবা হত। কুম্ভ মেলায়ও তিনি প্রচুর পরিমানে সাধু সেবা করতেন। তাঁর উদার হৃদয়, সাধু সেবা, প্রেমময় ব্যবহার, সদা প্রফুল্লবদন দর্শন করে সাধু সমাজ তাঁকে খুব শ্রদ্ধা করতেন।
১৯৭০ ইং সালে তিনি বৃন্দাবনের গোপীনাথ বাজারে তাঁর গুরুদেবের নামে “শ্রীশ্রী সন্তদাস বাবা আশ্রম” প্রতিষ্ঠা করলেন। ১৯৭৯ ইং সালে দক্ষিন ২৪ পরগণা জেলার লস্করপুরেও এই নামের আর একটি আশ্রমের প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৪ ইং সালে জানুয়ারী মাসে বৃন্দাবনের কুম্ভে তিনি “কাঠিয়া বাবা শ্রীশ্রীরামদাস খালসা” স্থাপন করলেনএবং এই খালসায় থেকে তিনি প্রত্যেক কুম্ভে প্রচুর পরিমানে সাধু সেবা ও ভক্ত সেবা করতেন।
দেহে থাকাকালীন তিনি “শ্রীশ্রী১০৮ স্বামী সন্তদাস বাবাজী মহারাজের উপদেশামৃত” ১ম ও ২য় খন্ড, “সংক্ষিপ্ত নিত্য কর্ম ও নিত্য পূজা পদ্ধতি”, প্রভৃতি পুস্তক লিখে প্রকাশিত করেছিলেন। “শ্রী শ্রী সন্তদাস চরিতামৃত” নামের তাঁর গুরুদেবের জীবনী তিনি দেহে থাকাকালীন লিখেছিলেন কিন্তু সেটা তাঁর দেহাবসানের পর প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর ৩৫টি সাধু শিষ্য ১৫০০র অধিক গৃহী শিষ্য-শিষ্যা ছিল। একদা একটি গ্রামে গ্রামবাসীদের অল্প সংখ্যক বৈষ্ণবদের উপর অত্যাচারের কথা শ্রবণ করে এবং সেই গ্রামবাসী বৈষ্ণবদের প্রার্থনায় তিনি তাঁর ইচ্ছা শক্তির প্রয়োগ করে সমস্ত গ্রামবাসীদের বৈষ্ণব করে দিয়েছিলেন। সাধারণতঃ তিনি তাঁর সমস্ত শক্তি লুকিয়ে রাখতেন এবং অপর সকল সাধারণ লোকেদের মতনই থাকতেন। তবে আধার ভেদে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার অনুভব তাঁর বহু শিষ্য ও ভক্তগণ করেছেন এবং এখনও করে থাকেন। তঁর অন্তর্যামিত্বের পরিচয় অনেকেই পেয়েছিল এবং তিনি বহুবার, দেহে থাকাকালীন এবং দেহাবসানের পরও, শিষ্যদেরকে দূরদেশে সশরীরে সাক্ষাৎ দর্শন দিয়ে কৃতার্থ করেছিলেন। তিনি ইং ১৯৮১ সালে লস্করপুর আশ্রমে মানব লীলা সম্বরণ করে মহাপ্রয়াণ করেন।
শ্রীমদগুরুস্তোত্রম্।
শ্রীবিষ্ণুস্বরূপং প্রেমাবতারং শ্রীমগুরুম্
প্রশান্তবদনং প্রফুল্ললোচনং মনোহরম্ ।।
জটাজুটবিভূষিতং করুণাময়বিগ্রহম্।
ধ্যায়েম শ্রীপ্রেমদাসং নররূপজগদীশ্বরম্ ।।
শ্রীরামদাসপ্রশিষ্যং কাষ্ঠকৌপীনভূষিতম্।
গোপীচন্দনচর্চিতং উন্নতসুললাটকম্ ।।
দিব্যকান্তিশুক্লবর্ণং কণ্ঠে তুলস্যাভূষণম্।।
ব্রজবিদেহিমহান্তং শ্রীপ্রেমদাসং ভজাম্যহম্ ।।
শ্রীনিম্বার্কপথানুগং হরিভক্তিপরায়ণম্।
অসীমপ্রভাবং সব্বাভিলাষপরিপূরকম্।।
কলিকল্মষপ্রণাশনং শ্রীসন্তদাসশিষ্যম্।।
পরং করুণাকরং, শ্রীপ্রেমদাসং ভজাম্যহম্।।
শাশ্বতং সব্বাতীতং চৈতন্যমেকং নিত্যম্।
সাকারং নিরাকারঞ্চ সৰ্ব্বজ্ঞমানন্দরূপম্।।
ভক্তিমুক্তিপ্রদাতারং সব্বশাস্ত্রবিশারদম্।
শরণাগতাশ্ৰয়ং শ্রীপ্রেমদাসং ভজাম্যহম্।।
সহর্ষেণ পদাম্বুজায় তে জ্ঞাত্বা ত্বমেকাশ্রয়ম্।
গুরুস্তোত্ৰমিদং নিত্যং কৃষ্ণদাসেন ভাষিতম্।।
ভক্তিমান যঃ পঠেদেতং লভতে স বরমীপ্সিতম্।
অচলাং ভক্তিং প্রাপ্নোতি লভতে চ মোক্ষং ধ্রুবম্।।
ইতি কৃষ্ণদাসেন কৃতং শ্রীমদ্গুরুস্তোত্রম্ সমাপ্তম্।