শ্রীনিম্বার্ক ভগবানের পরে দ্বাদশ আচার্য, অষ্টাদশ ভট্টাচার্য এবং দশ দেবাচার্য আমাদের গুরু হয়েছিলেন। সকলের সম্বন্ধে বিস্তার বিবরণ বা তাঁদের জীবনের সম্বন্ধে বহু কিছুই অজানা রয়ে আছে। যেমন যেমন তাঁদের সম্বন্ধে জানতে পারব তাঁদের সম্বন্ধেও এখানে প্রকাশ করার চেষ্টা করব। যাঁদের সম্বন্ধে আমাদের বহু কিছু জানা আছে তাঁদের মধ্যে একজন হচ্ছেন আমাদের ৩৯তম আচার্য – শ্রীস্বামী চতুরচিন্তামণি দেবাচার্যজী মহারজ, যিনি নাগাজী মহারাজ নামেও আখ্যাত ছিলেন। তিনি সখ্য ভাবে শ্রীভগবানের আরাধনা করতেন। ব্রজভূমির পায়গাম নামক গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। সন্ন্যাস গ্রহণ করে বর্ষাণার নিকট কদমখন্ডীনামক স্থানে ভগবৎ আরাধনার জন্য আগমন করেন। সেই স্থান প্রায় সর্বত্রই পর্বতশ্রেণী দ্বারা আবেষ্টিত। একটি নিকটবর্তী পাহাড়ের একটি গুহায় তিনি নিজের সাধনা করতেন। বহু বছর তিনি কঠোর তপস্যা করলেন কিন্তু শ্রীভগবানের দর্শন প্রাপ্ত হলেন না। তখন তিনি অভিমান করে মনস্থ করলেন যে তিনি ব্রজধাম ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাবেন। তিনি মনে মনে বিচার করলেন যে, “যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ এই ব্রজভূমিতেই সিদ্ধি লাভ করেছিলেন সেই জন্য তিনি অপর কাউকেই এই ভূমিতে সিদ্ধ হতে দেবেন না। অতএব আমি তাঁর ধাম পরিত্যাগ করে অন্যত্র গমন করে তপস্যা করব, দেখি তিনি কিভাবে আমাকে বাধা দেন।” এইরূপ চিন্তা করে তিনি নিজের চিমটা ও কমন্ডলু নিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করলেন কিন্তু বেশী দূরে যেতে পারলেন না কারণ, গমনকালে তাঁর বৃহৎ জটাসকল পথের চতুর্দিকে কন্টকাকীর্ণ বৃক্ষগুলিতে এমন ভাবে আবদ্ধ হয়ে পড়ল যে তিনি সম্মুখে অথবা পশ্চাতে কোনও দিকে যেতে পারলেন না। এই ভাবে অবশ হওয়াতে তাঁর শ্রীঠাকুরজীর প্রতি অভিমান আরও বৃদ্ধি প্রাপ্ত হল আর তিনি ভাবলেন, “শ্রীঠাকুরজী বড়ই শঠ এবং সেই শঠ চাতুরী করে আমার জটা সকল কাঁটায় বিদ্ধ করে দিয়ে আমাকে আটকে দিয়েছে। ঠিক আছে, আমি এই অবস্থায়ই থাকব, দেখি উনি আমার কি করতে পারেন।”
এই ভাবে তিন দিন ও তিন রাত্রি তিনি সেই অবস্থায় চলচ্ছক্তিবিহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। চতুর্থ দিনে ভক্তবৎসল ভগবান চতুর্ভুজ মূর্তি ধারণ করে তাঁর নিকট প্রকট হলেন এবং নাগাজী মহারাজকে দুই হস্তে আলিঙ্গনবদ্ধ করে অপর দুই হাতে তাঁর জটা সকলকে কন্টকগুলি থেকে মুক্ত করে তাঁকে বললেন, “নাগাজী, তুমি সিদ্ধ হয়েছ, এখানেই থাক। তুমি বর প্রার্থনা কর।” নাগাজী মহারাজ তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে ভগবানের অনেক স্তুতি করে তাঁকে দন্ডবৎ প্রণাম করলেন। ভগবানের আদেশে তিনি তাঁর কাছে বর প্রার্থনা করে বললেন, “ব্রজ ধামের আধা পূত ওআধা দুধ দাও।” সরল ভাবে বলতে গেলে তিনি ভগবানকে বললেন যে ব্রজ ধামে যত পুত্র সন্তান হবে তার অর্দ্ধেক গৃহী থাকবে এবং অপর অর্দ্ধেক সাধু হয়ে নাগাজীর সমাজ বৃদ্ধি করবে। সেই রকম, ব্রজবাসীদের অর্দ্ধেক দুধের ভাগ তাদের নিজের এবং অপর অর্দ্ধেক ভাগ সাধুদের থাকবে, যাতে সাধুরা ইচ্ছামতন সেই দুধ পান করে শ্রীঠাকুরজীর ভজন করতে পারে। শ্রীভগবান তাঁকে সেই বরদান করলেন, শুধু তাই নয় তিনি নাগাজী মহারাজের চেলার রূপ ধারণ করে ব্রজধামে সর্বত্র গমন করে নাগাজী মহারাজের সেই বরদানের প্রচার করলেন। কিছু দিনের মধ্যেই সমস্ত ব্রজমন্ডলে নাগাজী মহারাজের এই বর প্রাপ্তির কথা রটে গেল এবং শ্রী ভগবান তারপর অন্তর্নিহিত হলেন। আজ অব্ধি এই বরের প্রভাব ব্রজ মন্ডলে অল্প ভাবে হলেও দেখা যায়।
শ্রী নাগাজী মহারাজ বহু শক্তিশালী মহাপুরুষ ছিলেন। একটি কিংবদন্তি তাঁর জীবিত কালেও ছিল যে তিনি ব্রজ চৌরাশী ক্রোশ পরিক্রমা প্রতিদিন বায়ুবেগে অতি অল্প সময়ে পূর্ণ করতেন। এই কথাটি ভরতপুরের রাজার কানে গেল। তিনি নাগাজীকে পরীক্ষা করার জন্য পরিক্রমার সমস্থ স্থলে নিজের লোক লাগিয়ে দিলেন এই দেখার জন্য যে নাগাজী মহারাজ সত্যই কি পরিক্রমার সমস্ত স্থান করেন কি না। নাগাজী মহারাজ সমস্ত তীর্থ সকল ত দর্শন করলেনই, তিনি আবার রাজার লোকগুলিকে খুঁজে বার করে তাদের সাথে বিশেষ করে আলাপ করলেন যাতে রাজার মনে কোনও রূপ সন্দেহ না থাকে। কথিত আছে যে এই ঘটনার পর নাগাজী মহারাজের উপর শ্রদ্ধান্বিত হয়ে ভরতপুরের রাজা তাঁর শরণ গ্রহণ করে তাঁর কাছে দীক্ষিত হন।