দ্বৈতাদ্বৈত সিদ্ধান্ত

দ্বৈতাদ্বৈত সিদ্ধান্ত

সংক্ষিপ্ত পরিচয়

ভারতবর্ষের চারটি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে নিম্বার্ক সম্প্রদায় প্রাচীনতম বলে বিখ্যাত। এই সম্প্রদায়ের উপাসনা প্রণালী বেদান্ত সম্মত এবং বেদান্তের মূল তত্ত্ব সকলের উপরে প্রতিষ্ঠিত। বেদান্তে বলা হয়েছে যে মুক্তি বা মোক্ষই হচ্ছে জীবের সর্বোৎকৃষ্ট প্রাপ্তি এবং মনুষ্য জীবনের লক্ষ্য।  নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্তকে দ্বৈতাদ্বৈত সিদ্ধান্ত বলা হয়। এর নামান্তর হচ্ছে – ভেদাভেদ সিদ্ধান্ত। এই সম্প্রদায়ে গুরুপরম্পরার চতুর্থ গুরু – শ্রীনিম্বার্ক ভগবান এই সিদ্ধন্তের প্রবর্তক। ভগবান শ্রী হরির আযুধ, সুদর্শন চক্রের অবতার রূপে তিনি বিখ্যাত। তৈলঙ্গ ক্ষেত্রের বৈদুর্যপত্তনম গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম ছিল অরুণ এবং মাতা ছিলেন জয়ন্তী। বাল্য কালেই তাঁর মাতা-পিতা তাঁকে নিয়ে ব্রজভূমিতে চলে আসেন। বরসানার নিকট নিম্বগ্রামে তাঁরা বাস করতে লাগলেন। এখানেই শ্রীনারদ ঋষি দ্বারা শ্রীনিম্বার্ক স্বামী দীক্ষা প্রাপ্ত হলেন এবং কঠোর সাধনা করে পূর্ণ সিদ্ধ মনোরথ হলেন। তার পরে তিনি ভারতবর্ষে একজন অলৌকিক বিভূতি সম্পন্ন তত্ত্বজ্ঞানী সাধক রূপে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থসকলের মধ্যে প্রধান হচ্ছে –  বেদান্ত পারিজাত সৌরভ, বেদান্ত দর্শনের একটি সংক্ষিপ্ত ও গভীর ভাষ্য, যার মধ্যে তিনি ব্যাসদেবের প্রণীত বেদান্ত দর্শনের ব্যাখ্যা করে দ্বৈতাদ্বৈত সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর অন্য একটি রচনা হচ্ছে – বেদান্তকামধেনূ, যাকে দশশ্লোকীও বলা হয়। তার নামানুরূপ তার মধ্যে তিনি দ্বৈতাদ্বৈত সিদ্ধান্তানুসারে এই সম্প্রদায়ের উপাসনা প্রণালীকে প্রকাশিত করেছেন। উপাস্য দেবের বা ইষ্টদেবের প্রতি গভীর ভক্তি এই সিদ্ধান্তের একটি প্রধান অঙ্গ।

পরব্রহ্ম, ঈশ্বর, জীব ও জগৎ, এই সকলের মধ্যে পরস্পর সম্বন্ধ কি, তাই দ্বৈতাদ্বৈত সিদ্ধান্তের দ্বারা প্রকাশিত করা হয়েছে। বেদান্ত দর্শন, যাকে ব্রহ্মসূত্র অথবা উত্তর মীমাংসাও বলা হয়, বলেন যে, পরব্রহ্ম হচ্ছেন অনন্ত নামরূপে প্রকাশিত এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অনাদি সৃষ্টিকর্তা। এই জগৎ পরব্রহ্ম থেকে উৎপন্ন হয়, তাঁতেই স্থিত আছে ও তাঁরই শক্তির দ্বারা পালিত হয়, এবং শেষে তাঁতেই লয় হয়ে যায়। জীব, জগৎ এবং ঈশ্বর পরব্রহ্মের অভিন্ন ও নিত্য শক্তি স্বরূপ। পরব্রহ্মের যে নিরাকার, নির্গুণ ও অক্ষর স্বরূপ, সেটাই এই তিন শক্তির আধার ও আশ্রয়। তিনিই সর্বাশ্রয় হয়ে এই শক্তিত্রয়কে প্রকাশিত করেন কিন্তু তিনি এই সকলকে অতিক্রম করেও বিদ্যমান আছেন। শক্তি ও গুণ সমার্থক শব্দ, সেই জন্য পরব্রহ্মকে সশক্তিক বলাতে তাঁকে সগুণও বলা হল বুঝতে হবে। অর্থাৎ – পরব্রহ্ম এক দিকে যেমন নির্গুণ, নিরাকার, ও নিষ্ক্রিয়; অপর দিকে তিনি সগুণ, সাকার, সর্বশক্তিমান ও সৃষ্টি-স্থিতি-লয় ব্যাপারের আদি কারণ। তিনিই এই জগতের উপাদান ও নিমিত্ত কারণ। এক দিকে তিনি সর্বব্যাপী, অখণ্ড, অদ্বৈত, নির্বিকার, কালাতীত, নিরাকার ও ইন্দ্রিয়াতীত; অপর দিকে তিনি সর্বশক্তিমান, নিজের স্বরূপগত ও নিত্য শক্তির দ্বারা তিনি জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় আদি ব্যাপার করতে সক্ষম। যে কোনও কাজ করার জন্য শক্তির প্রয়োজন হয়, এবং পরব্রহ্ম জগতের সৃষ্টি আদির কারণ হওয়াতে তিনি সগুণ ও ধ্যানগম্য, তাও সহজেই বোধগম্য করা যায়। এই বিষয়ে অনেক শ্রুতি প্রমাণ আছে।

এই পরব্রহ্ম জড় নন; তিনি চেতনা সম্পন্ন, তিনি জ্ঞাতা, তিনি দ্রষ্টা বা অনুভবকর্তা। যে শক্তির দ্বারা তিনি জ্ঞান সম্পন্ন হন তাকে চিৎ শক্তি, ঈক্ষণ শক্তি ইত্যাদি নাম দেওয়া হয়েছে। এই চিৎ শক্তির দ্বারা তিনি নিজ স্বরূপ জ্ঞাত আছেন। অর্থাৎ –  এই চিৎ শক্তি তাঁর স্বরূপকে নিজের জ্ঞানের বিষয় করে। তাঁর এই যে অনুভব, সেটা আনন্দদায়ক, অর্থাৎ – পরব্রহ্ম নিজের চিৎ শক্তির দ্বারা নিজের আনন্দময় স্বরূপকে অনুভব করেন। সেই জন্য শাস্ত্রে তাঁকে  – সচ্চিদানন্দ (সৎ-চিৎ-আনন্দ) বলা হয়েছে। সৎ শব্দটি অস্তিত্ব বোধক; পরব্রহ্ম সর্বদা অদ্বৈত, একরস, অখণ্ড ও নির্বিকার রূপে বিদ্যমান সেই জন্য তিনি সৎ। ভূত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, কোনোকালেই তাঁর স্বরূপে কোনও রকম পরিবর্তন হয় না সেই জন্যই তিনি সৎ। এই জগতে আমরা এমন কোনও বস্তু বা পদার্থ দেখতে পাই না যেটা ত্রিকালে নির্বিকার রূপে থাকে। এই জগতের প্রত্যেক বস্তু ও অবস্থা প্রতি ক্ষণে পরিবর্তিত হয়ে চলেছে, পরন্তু পরব্রহ্ম এ থেকে বিলক্ষণ; কোনও কালেই তাঁর স্বরূপের কোনও রকম পরিবর্তন হয় না বলেই তিনি সৎ স্বরূপ। একটু নিবিষ্ট চিত্তে বিচার করলে বোঝা যায় যে, পরব্রহ্ম অদ্বৈত, অখণ্ড ও সর্বব্যাপী না হলে তাঁর আনন্দময় হওয়া অসম্ভব। তাঁর অতিরিক্ত অন্য কোনও বস্তু বা পদার্থের অস্তিত্ব থাকলে তিনি তার দ্বারা সীমিত হয়ে যান। যা সীমিত তার একটা অভাব বোধ থাকে, যার অভাব বোধ আছে সে কখনও আনন্দময় হতে পারে না।  শ্রুতি বলেছেন –

যো বৈ ভূমা তৎসুখং, নাল্পে সুখমস্তি। ভূমৈব সুখম্।

অর্থাৎ – যা ভূমা (অসীম ও অনন্ত) তাই সুখ, যেটা সীমিত তাতে সুখ নাই, অতএব ভূমাই সুখ।

শ্রুতি আরও বলেছেন – যো বৈ ভূমা তদমৃতম্। অথ যদল্পং তন্মর্ত্যম্।

অর্থাৎ – যা ভূমা তাই অমৃত, যেটা সীমিত, সেটা মরণধর্মশীল। সেই জন্য শ্রুতি যখন ব্রহ্মকে আনন্দময় বলেন তখন তাতেই তাঁর অদ্বৈত ও অখণ্ড হওয়া স্বয়ংসিদ্ধ হয়ে থাকে।

আনন্দের বিষয় চিন্তা করলে জানা যায় যে আনন্দ জ্ঞান সাপেক্ষ; জ্ঞান না থাকলে আনন্দের অনুভূতি হওয়া অসম্ভব এবং সেই আনন্দ বস্তুতঃ অস্তিত্বহীন। কোনো বস্তুর জ্ঞানের অভাবে সেটা তোমার জন্য অস্তিত্বহীনই বলা হবে। চিনি একটি মিষ্ট পদার্থ পরন্তু চিনি নিজের মিষ্টত্ব বুঝতে পারে না কারণ চিনি জড় বস্তু। মানুষ চিনির মিষ্টত্ব অনুভব করতে পারে কারণ সে চেতনাযুক্ত, মিষ্টত্ব অনুভব করার সামর্থ্য তার আছে। চিনির মিষ্টত্ব মনুষ্যের জ্ঞান সাপেক্ষ। চিনির মিষ্টত্বের অনুভবকর্তা যদি কেউ না থাকে তা হলে সেটা অস্তিত্বহীনই বলা হবে।  কিন্তু, আগে বলা হয়েছে যে পরব্রহ্ম অদ্বৈত, তিনি ভিন্ন অন্য কোনও বস্তু নাই। তাহলে তাঁর স্বরূপকে যখন আনন্দময় বলা হল তার অর্থ এই যে, সেই আনন্দের অনুভবকর্তাও তিনি স্বয়ং। যে শক্তির প্রভাবে তিনি নিজের আনন্দময়তা জ্ঞাত হন বা অনুভব করেন সেই শক্তির নাম – চিৎ শক্তি। এই সকল যুক্তিকে একত্রে বিচার করলে দাঁড়ায় যে, পরব্রহ্ম অদ্বৈত সৎ স্বরূপ; তিনি জড় নন, তিনি চিৎ শক্তি সম্পন্ন অর্থাৎ তিনি জ্ঞাতা সেই জন্য তিনি চিৎ স্বরূপ; নিজের চিৎ শক্তি দ্বারা তিনি নিজের স্বরূপের জ্ঞাতা বা অনুভবকর্তা এবং এই অনুভব আনন্দময়, সেই জন্য তিনি আনন্দময়।

এটা মনে রাখতে হবে যে তাঁকে সচ্চিদানন্দ বলাতে তাঁকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়নি। তিনি পরম অদ্বৈত, নির্বিকার এবং অব্যয়; তাঁর কোনও অপচয়-উপচয় নাই।  তিনি নিজেই নিজের আনন্দময়তার জ্ঞাতা। জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতা বিভাগ তাঁর মধ্যে নাই। যিনি জ্ঞাতা, তিনিই জ্ঞেয় (জ্ঞানের বিষয়), এবং তিনিই জ্ঞান (আনন্দস্বরূপ)। কিছুটা এই ভাবে বুঝবে যে, মনে কর তিনি একটি শরীর যেটা আনন্দ দিয়ে তৈরী আর তিনি জানেন যে “আমি আনন্দ।” এই আনন্দ বাইরের কোনও বিষয় নয়, এটা স্বরূপগত আনন্দ যেটা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে তিনি অনুভব করেন, এটা আনন্দ অনুভবকর্তা বা জ্ঞাতা থেকে অভিন্ন।  ঠিক সেই রকম, পরব্রহ্ম নিজের স্বরূপগত আনন্দের জ্ঞাতা, এই আনন্দই তাঁর স্বরূপ এবং তাঁর থেকে অভিন্ন।

যে শক্তির দ্বারা পরব্রহ্ম নিজের স্বরূপগত আনন্দকে অনুভব করেন তাকে চিৎ শক্তি বলে। এই চিৎ শক্তি তাঁর নিত্য স্বরূপগত শক্তি। যখন এই চিৎ শক্তি তাঁর আনন্দকে এক, অখণ্ড এবং নিরবিচ্ছিন্ন রূপে অনুভব করে তখন তাকে ঈশ্বর বলা হয়। পরন্তু এই শক্তি যখন তাঁর স্বরূপগত আনন্দের বিশেষ বিশেষ অংশকে অসংখ্য রূপে, পরিচ্ছিন্ন ভাবে, একটি ক্রমানুসারে পর-পর অনুভব করে তখন একে জীব সংজ্ঞা দেওয়া হয়। অন্য কথায় বলতে গেলে, তাঁর স্বরূপগত আনন্দের এই রকম যোগ্যতা আছে যে অবিকৃত থেকেও সেটা ভিন্ন ভিন্ন রূপে চিৎ শক্তির দ্বারা জ্ঞাত হওয়া যায়। অপর দিকে তাঁর চিৎ শক্তিও পরব্রহ্মের স্বরূপগত আনন্দকে অসংখ্য রূপে অনুভব করতে পারে।

এই যে অনন্ত রূপ ব্ৰহ্মে প্রকাশিত হয়, তারই নাম জগৎ ; তাঁর চিৎশক্তি একে আপন জ্ঞানের বিষয় করে। তৎসমস্ত একসঙ্গে সম্যক্ অনুভবকর্তা ( দর্শনকর্তা) রূপে তাঁর “ঈশ্বর” সংজ্ঞা হয় ; অতএব ঈশ্বর নিত্যসর্বজ্ঞ। আর বিশেষ বিশেষ রূপে পর পর দর্শনকর্তারূপে তাঁর “জীব” সংজ্ঞা হয়। অতএব জীব বিশেষজ্ঞ, এককালে সমগ্র-দ্রষ্টা নয়। সুতরাং ঈশ্বরত্ব এবং জীবত্ব উভয়ই ব্রহ্মের অঙ্গীভূত চিৎশক্তিরই প্রকারভেদ মাত্র, উভয়ই নিত্য। ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমানে প্রকাশিত সমস্ত রূপই সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের জ্ঞানে নিত্য প্রতিষ্ঠিত থাকাতে জগৎও অনাদি এবং এই অর্থে সত্য। ঈশ্বরের নিত্য-সৰ্বজ্ঞতাহেতু তিনি কালাতীত, তাঁর জ্ঞানের কোন ক্রমভেদ নাই। পরন্তু জীব স্বরূপতঃ বিশেষজ্ঞ মাত্র হওয়ায়, ঈশ্বরজ্ঞানে যা নিত্য প্রতিষ্ঠিত আছে সেই রূপ সকলই তিনি পর পর ভাবে দর্শন করেন। সুতরাং জীবের জ্ঞানে জাগতিক বস্তু সকল পর পর ভাবে প্রকাশিত হয়, এবং তারা উৎপত্তি, স্থিতি ও লয়শীল রূপে সর্বদা বর্তমান থাকে। অতএব জীবজ্ঞানে জগৎ অনিত্য—সদা পরিবর্তনশীল। পরন্তু সর্বজ্ঞ ঈশ্বর জ্ঞানে যাহা নিত্য স্থিত আছে, তাঁকে অতিক্রম করে বিশেষজ্ঞ জীবের জ্ঞানে কিছু প্রকাশিত হতে পারে না; সুতরাং জীব নিত্যই ঈশ্বরাধীন, ঈশ্বরের দ্বারা জীবের সর্ববিধ দর্শনকাৰ্য্য নিত্য নিয়মিত হচ্ছে।

যে শক্তির প্রভাবে পরব্রহ্ম এক, অখণ্ড ও অদ্বৈত হয়েও বহুরূপী, দ্বৈত এবং খণ্ডিত রূপে প্রতিভাত হন; আনন্দময় হয়েও যে শক্তির প্রভাবে তিনি জীব জ্ঞানে জড় জগৎরূপে প্রতিভাত হন – সেই শক্তির নাম “মায়া।” প্রকৃতি এর নামান্তর। মীয়তে অনয়া ইতি মায়া – অর্থাৎ, যার দ্বারা পরব্রহ্ম একরস, চৈতন্যময়, অদ্বৈত, নির্বিকার ও অখণ্ড হয়েও বহুরূপী, জড় জগৎ, দ্বৈতভাবাপন্ন, পরিবর্তনশীল ও বহু খণ্ড বিশিষ্ট রূপে প্রতিভাত হন, সেই শক্তিই হচ্ছে – মায়া।  যেমন সূর্যের আলো এক বর্ণ হয়েও জলকণার ভিতর দিয়ে প্রকাশিত হলে সাতটি বর্ণে প্রতিভাত হয়; ঠিক সেই প্রকার, পরব্রহ্ম এক হয়েও মায়া শক্তির প্রভাবে জীব জ্ঞানে অনন্তরূপে প্রকাশিত হন। কিন্তু, মায়ার প্রভাব কেবল জীবরূপী চিৎ শক্তির উপরেই হতে পারে; ঈশ্বর মায়াধীশ, তাঁর উপর মায়া কোনও প্রকার প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। মায়া নামের এই প্রিজ্ম যখন জীব ও পরব্রহ্মের স্বরূপগত আনন্দের মাঝখানে চলে আসে তখন পরব্রহ্ম জীবের নিকট জগৎরূপে প্রতিভাত হন। সদ্গুরুর কৃপায় যখন জীব তাঁর আশ্রয় লাভ করে উপযুক্ত সাধন-ভজন করে তখন সে মায়ার প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে পরব্রহ্মের আনন্দময়তা অনুভব করে এবং নিজেও সেই আনন্দে প্রতিষ্ঠিত হয়।

ঈশ্বর ও জীব, দুটোই পরব্রহ্মের নিত্য ও আত্মভূতা চিৎ শক্তির প্রকারভেদ; দুটোই সচ্চিদানন্দস্বরূপ। পরন্তু এই রূপ হয়েও দুটোর মধ্যে কিছু কিছু বিশেষ প্রভেদ আছে। ঈশ্বর নিত্য সর্বজ্ঞ, জগতের ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যের সকল অবস্থা তাঁর জ্ঞানে সর্বদা প্রকাশিত থাকে এবং সেই জন্য তিনি কালাতীত। অন্য দিকে জীবের জ্ঞান কাল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এক পূর্বনির্দিষ্ট ক্রমানুসারে এই জগৎ তাঁর জ্ঞানে প্রকাশিত হয়। একটা কারণ-কার্য প্রণালী দ্বারা এই জগৎ এবং তার সমস্ত অবস্থা সকল ভূত-বর্তমান-ভবিষ্য, এই ক্রমানুসারে তার জ্ঞানে প্রকাশিত হয়। সেই জন্য জীব কালাধীন। জীবের জ্ঞানে ভূত-বর্তমান-ভবিষ্য, কখনও একসঙ্গে প্রকাশিত হতে পারে না। সেই জন্য জীবের জ্ঞান কখনো ঈশ্বরের জ্ঞানকে অতিক্রম করতে পারে না। যা ঈশ্বরের জ্ঞানে নিত্য প্রকাশিত, তাই জীবের জ্ঞানে ভূত-বর্তমান-ভবিষ্য, এই ক্রমানুসারে পর পর প্রকাশিত হয়।

ঈশ্বর ও জীবে দ্বিতীয় প্রভেদ এই যে, জীব সচ্চিদানন্দ হয়েও মায়ার দ্বারা প্রভাবিত হন এবং তার বদ্ধাবস্থা ও মুক্তাবস্থা, দুটিই হয়ে থাকে। বদ্ধ জীব সাধনার দ্বারা মুক্তি লাভ করে নিজের সচ্চিদানন্দ স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। অন্য দিকে ঈশ্বর মায়ার প্রভাব থেকে সর্বদা মুক্ত সেই জন্য তিনি নিত্য-মুক্ত এবং সর্বদা তাঁর সচ্চিদানন্দ স্বরূপে স্থিত।

জীবরূপী চিৎ শক্তি দ্বারা পরব্রহ্ম নিজের স্বরূপগত আনন্দকে অসংখ্যরূপে দর্শন করেন সেই জন্য জীব অনন্ত। জীব অণু স্বভাব ও ঈশ্বর বিভু স্বভাব। জীব ও ঈশ্বর, পরব্রহ্মের চিৎ শক্তির  প্রকার ভেদ এটা পূর্বে বলা হয়েছে। নামরূপ বিশিষ্ট প্রত্যেক দেহ পিণ্ডকে আশ্রয় করে যে শক্তি আত্মবোধে তাতে নিহিত রয়েছে, সেটাই জীব। আর সম্পূর্ণ জগৎ ও তাতে প্রকাশিত সমস্ত জীব সকলকে  আত্মবোধে, নিজের আত্মস্বরূপে স্থিত বলে যে চিৎ শক্তি জ্ঞাত আছে, তাই ঈশ্বর। যেমন অগ্নি ও তার স্ফুলিঙ্গ, অথবা সূর্য ও তার রশ্মি। অগ্নির স্ফুলিঙ্গে অগ্নির সমস্ত গুণ বর্তমান থাকে, কিন্তু অগ্নি ব্যাপক ও স্ফুলিঙ্গ ব্যাপ্য; অগ্নি বিভূ ও স্ফুলিঙ্গ অণু। গুণে ও স্বরূপে সমান হলেও দুটোর মধ্যে ভেদ আছে। আবার স্ফুলিঙ্গ অগ্নিরই অংশ, অগ্নি থেকে তার পৃথক অস্তিত্ব নাই সেই জন্য অগ্নি ও স্ফুলিঙ্গ অভিন্নও বটে।

ঠিক সেই রকম জীব ও ঈশ্বরের মধ্যে ভেদাভেদ সম্বন্ধ রয়েছে। জীব ঈশ্বরেরই অংশ, তাঁর থেকে অভিন্ন, তাঁর থেকে প্রকাশিত ও তাঁতেই সে স্থিত; পরন্তু এই রূপ হয়েও সে ঈশ্বরের সমান নয়, সেই জন্য জীব ও ঈশ্বরের মধ্যে ভেদও রয়েছে।  ঈশ্বর ও জীবের এই দ্বৈত-অদ্বৈত রূপে স্থিতিকেই দ্বৈতাদ্বৈত বা ভেদাভেদ সম্বন্ধ বলা হয়।  এটাই দ্বৈতাদ্বৈত সিদ্ধান্তের সার।

ঈশ্বর ও জীব পরব্রহ্মের চিৎ শক্তির প্রকারভেদ এটা পূর্বে বলা হয়েছে, জগৎ তাঁর মায়া শক্তির প্রকাশ এটাও আগে বলেছি। কিন্তু শক্তির কোনো আধার না থাকলে শক্তি থাকতে পারে না। যিনি সমস্ত শক্তির আধার ও সর্বাশ্রয়, যিনি সর্বশক্তিমান, অব্যয়, ইন্দ্রিয়াতীত, নির্গুণ, নিরাকার, ও পরম অদ্বৈত, তাঁকে অক্ষর ব্রহ্ম বলা হয়। শক্তিমানকে ছেড়ে শক্তি কখনো থাকতে পারে না। এই অক্ষর পরব্রহ্ম জীব, জগৎ ও ঈশ্বরের পরম আশ্রয়রূপে সর্বদা স্থিত। এই সর্বাশ্রয়, নির্গুণ ও নিরাকার ভাবকেই বিশেষ রূপে লক্ষ্য করে শ্রুতি তাঁকে এই ভাবে বর্ণনা করেছেন। মনে রাখতে হবে যে শক্তি ও শক্তিমান অভিন্ন, শক্তি কখনো শক্তিমান থেকে পৃথক থাকতে পারে না এবং সর্বশক্তিমান বলাতে তাঁর সশক্তিক অথবা সগুণ হওয়াও প্রমাণিত হয়। সেই জন্য পরব্রহ্ম একাধারে যেমন নিরাকার ও নির্গুণ, আবার অন্য দিকে তিনি সাকার ও সগুণ।

এই জগৎ তাঁর শক্তির প্রকাশ হওয়াতে তাঁর থেকে অভিন্ন, তাঁরই অংশ ও তাঁতেই স্থিত। এটা ভ্রম বা মিথ্যা নয়। এটা যে পরব্রহ্ম থেকে পৃথকরূপে অস্তিত্বশীল এই জ্ঞানই ভ্রমাত্মক। ঈশ্বর, জীব ও জগৎ, নির্গুণ নিরাকার পরব্রহ্মে তাঁর নিত্য শক্তি রূপে তাঁর থেকে অভিন্নরূপে সর্বদা স্থিত রয়েছে। মায়া শক্তির প্রভাবে জগৎ জীবজ্ঞানে তাঁর থেকে পৃথক ও জড় রূপে প্রতিভাত হয়। জীব জ্ঞানে এই জগৎ উৎপত্তি-স্থিতি-বিনাশশীল ভাবে প্রকাশিত হয়। কিন্তু ঈশ্বর এই জগৎকে নিজে থেকে অভিন্নরূপে, অখণ্ড আনন্দময়রূপে অনুভব করেন। জীব জ্ঞানে এই অনন্ত নামরূপী জগৎ যেন তাঁর থেকে প্রকাশিত হয়, প্রকাশিত হয়ে তাঁর মধ্যে স্থিতিশীল, এবং শেষে প্রলয়কালে নিজের নামরূপ আদি ভেদভাব রহিত হয়ে তাঁর মধ্যেই লয় হয়ে যায় ও তাঁতেই অপ্রকাশিত ভাবে থাকে। সৃষ্টি কালে আবার জীব জ্ঞানে জগৎ উৎপন্ন হয় এবং এই প্রক্রিয়া অনাদি কাল থেকে চলছে।

এই সকল কথাগুলি সম্মিলিত ভাবে বিচার করলে বলা যায় যে পরব্রহ্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে হলে তাঁকে চতুষ্পাদ বিশিষ্ট বলা হয়।

১) জগৎ – দৃশ্য স্থানীয় প্রথম পাদ। এই অনন্ত নামরূপ বিশিষ্ট প্রকাশিত জগৎ যেটা সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের ক্রমানুসারে জীব জ্ঞানে প্রকাশিত হয়, প্রত্যেক ক্ষণে পরিবর্তনশীল হওয়াতে যাকে গতিশীল বা বিনাশশীল বলা হয় – এই দৃশ্যমান জগৎই পরব্রহ্মের প্রথম পাদ।

২) জীব – দ্রষ্টা স্থানীয় দ্বিতীয় পাদ। এই জগতে সমস্ত নামরূপ বিশিষ্ট দেহপিণ্ডে যে চিৎ শক্তি তাদের দ্রষ্টারূপে বিদ্যমান ও যার থাকায় জীব নিজেকে চেতনা সম্পন্ন জ্ঞান করে, সেই জীব রূপী চিৎ শক্তিই পরব্রহ্মের দ্বিতীয় পাদ।

৩) ঈশ্বর – সম্যক্ দ্রষ্টা রূপ তৃতীয় পাদ। যে চিৎ শক্তি এই অনন্ত নামরূপ বিশিষ্ট জগতের প্রত্যেক অংশে নিহিত, জগৎকে ও জীব সকলকে নিজে থেকে অভিন্ন ও আত্মস্বরূপে জ্ঞাত আছে এবং এতৎ সমস্তকে এক অখণ্ড আনন্দময়রূপে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে অনুভব করে, সেই চিৎ শক্তিকে ঈশ্বর বলা হয়। এই ঈশ্বরই পরব্রহ্মের তৃতীয় পাদ। ইনি সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান। তাঁর স্বরূপগত আনন্দই এই জগতের উপাদান কারণ ও তাঁর জীব রূপী চিৎ শক্তিই জগতের নিমিত্ত কারণ। যেমন মাকড়শা নিজের শরীর থেকে জাল সৃষ্টি করে এবং শেষে নিজের শরীরের মধ্যেই তাকে লয় করে নেয়, সেই জন্য মাকড়শা সেই জালের নিমিত্ত ও উপাদান কারণ দুটোই।  ঠিক সেই রকম, জীব ও জগৎ ঈশ্বর থেকে প্রকাশিত হয়, তাতেই স্থিত ও তাঁতেই লয় হয়ে যায়।

অক্ষর ব্রহ্ম – অদ্বৈত, মন, বুদ্ধি ও বাক্যের অতীত চতুর্থ পাদ। যিনি নির্গুণ, নিরাকার, পরম অদ্বৈত, নির্বিকার, সর্বাশ্রয়, সকল প্রকার নামরূপ আদি বর্জিত ও ইন্দ্রিয়াতীত; যিনি জীব, জগৎ ও ঈশ্বররূপী শক্তি ত্রয়ের আশ্রয় ও আধার রূপে তদাতীত ও অব্যয় রূপে স্থিত, যাঁর সম্বন্ধে কেবল এই মাত্র বলা যায় যে, তিনি আছেন; সেই সৎ রূপী অক্ষর ব্রহ্ম সেই পরব্রহ্মের চতুর্থ পাদ।

এই সকল বিচারের সার তত্ত্ব এই যে –

শ্রীনিম্বার্ক ভগবানের প্রবর্তিত দ্বৈতাদ্বৈত সিদ্ধান্তানুসারে পরব্রহ্ম, যিনি ইন্দ্রিয়াতীত, অব্যয়, নির্বিকার, সর্বাশ্রয় এবং এই জগতের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও লয়কর্তা, তাঁকে নিত্য চতুষ্পাদ বিশিষ্ট বলা হয়। অক্ষর পাদ, জীব পাদ, জগৎ পাদ ও ঈশ্বর পাদ, পরব্রহ্মকে ব্যাখ্যা করতে হলে তাঁকে এই চতুষ্পাদরূপে পূর্ণ বলা হয়। অক্ষর স্বরূপে তিনি নির্গুণ, নিরাকার এবং ইন্দ্রিয়াতীত। ঈশ্বর স্বরূপে তিনি এই অনন্ত প্রকাশিত জগৎরূপী দেহ বিশিষ্ট পুরুষ এবং তিনি এই জগৎকে নিজে থেকে অভিন্ন ও আনন্দরূপে জ্ঞাত আছেন; সেই জন্য তাঁকে পুরুষোত্তম বলা হয়। জীবরূপে তিনি নিজের স্বরূপগত আনন্দের বিশেষ বিশেষ অংশকে অসংখ্য রূপে দর্শন করেন এবং প্রত্যেক নামরূপ বিশিষ্ট দেহপিণ্ডে তিনি তার দ্রষ্টারূপে স্থিত আছেন। জগৎ রূপে তিনি এই অনন্ত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডরূপে প্রকাশিত, সাবয়ব ও ত্রিগুণাত্মক রূপী। তাঁর অক্ষর পাদ অন্য তিন পাদের, অর্থাৎ – জীব, জগৎ ও ঈশ্বরের, অতীত এবং এদের সর্বাশ্রয়রূপে স্থিত। এই জগৎ তাঁরই আনন্দরূপী উপাদান থেকে সৃষ্ট, সেই জন্য এটা মিথ্যা অথবা কল্পনা মাত্র নয়। এই জগৎ তাঁর নিত্য শক্তি রূপে তাঁর থেকে অভিন্ন রূপে স্থিত, শুধু জীব জ্ঞানে এটা কখনো প্রকাশিত হয় কখনো অপ্রকাশিত থাকে। এই অনন্ত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডেরূপী দেহকে তিনি ঈশ্বররূপী চিৎ শক্তি দ্বারা এক অখণ্ড ভাবে ব্যাপ্ত করে আছেন। ঈশ্বররূপী চিৎ শক্তির অসংখ্য অংশ যেন তাঁর থেকে প্রসারিত হয়ে তাঁর স্বরূপগত আনন্দকে অসংখ্যরূপে অনুভব করছে।। অখণ্ড ঈশ্বররূপে ও তাঁর অসংখ্য জীব রূপে চিৎ শক্তি পরব্রহ্মে নিত্য বিরাজমান। জীব ঈশ্বরেরই চিৎ রূপী অংশ এবং সর্বতোভাবে ঈশ্বরের অধীন, সেই জন্য জীব ঈশ্বর থেকে অভিন্ন এবং যেহতু ঈশ্বর জীব ও জগৎকে অতিক্রম করেও বিরাজমান, সেই জন্য জীব তাঁর থেকে ভিন্নও বটে। এই দ্বৈত-অদ্বৈত অথবা ভেদ-অভেদ ভাব পরব্রহ্মে নিত্য বিদ্যমান।

অগ্নির স্ফুলিঙ্গে যেমন অগ্নির প্রায় সমস্ত গুণই বিদ্যমান থাকে কিন্তু অগ্নির সত্তা অসংখ্য স্ফুলিঙ্গ সকলকে অতিক্রম করে থাকে। স্ফুলিঙ্গ অণু স্বভাব কিন্তু অগ্নি বিভু স্বভাব। ঠিক সেই রকম, জীব ঈশ্বরের অংশ, তাঁর থেকে অভিন্ন কিন্তু ঈশ্বর জীবকে অতিক্রম করেও স্থিত আছেন। জীব ঈশ্বরের অংশ হওয়াতে জীব অণু এবং ঈশ্বর বিভু।

মনুষ্য যেমন নিজেকে এক অখণ্ডরূপে সর্বদা অনুভব করে পরন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার নিজের প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জ্ঞানও তার ভিতরে বিদ্যমান থাকে। ঠিক সেই প্রকার পরব্রহ্ম নিজেকে ঈশ্বর রূপে নিজের চিৎ শক্তির দ্বারা এক অখণ্ডরূপে নিত্য জ্ঞাত আছেন, আবার সেই চিৎ শক্তির পৃথক-পৃথক অংশের দ্বারা নিজের স্বরূপকে তিনি অনন্ত জীব রূপেও জ্ঞাত থাকেন। এই দুই স্বরূপই তাঁর মধ্যে নিত্য বিরাজমান। যখন জীব নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরাধীন ও তাঁর অভিন্ন আনন্দময় অংশরূপে জানতে পারে তখন তাকে মুক্ত জীব বলা হয়। পরন্তু যখন সে নিজেকে তাঁর থেকে পৃথক, স্বাধীন ও দেহ সর্বস্ব মনে করে তখন তাকে বদ্ধ জীব বলা হয়। জীবের গতি বদ্ধাবস্থা থেকে মুক্তাবস্থার দিকে হয়, তার বিপরীত কখনো হয়না। মুক্তাবস্থাই জীবের নিজের স্বরূপ, এবং তার প্রাপ্তিই মোক্ষ বলে কথিত হয়। মুক্তাবস্থা প্রাপ্ত জীব নিজেকে এবং এই চরাচর বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরাধীন এবং ঈশ্বরের অভিন্ন অংশরূপে জ্ঞাত হয় এবং “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”, এই জ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে নিজের সচ্চিদানন্দরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।

CONTINUE READING
Share this post

1 thought on “দ্বৈতাদ্বৈত সিদ্ধান্ত

Comments are closed.

Come2theweb